
ক্রিকেটার আকবর আলীর জীবনের গল্প। বাংলাদেশের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ক্রিকেটার আকবর আলী।
বাংলাদেশ একদিন ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতবে এমন ধারণা কয়েকদিন আগেও ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। তবে হ্যাঁ, অনেকবার ভাল দল গড়ে, প্রস্তুতি নিয়ে, এমন কি ঘরের মাঠেও বিশ্বকাপ আয়োজন করে আশা জাগিয়েছে বাংলার ক্রিকেট দল। কিন্ত সেই আশায় গুড়েবালি হয়েছে প্রত্যেকবার। পাহার সমান চাপের ভারী বোঝা নিয়ে তীড়ে এসে প্রত্যাশার তরী আর ভেসে থাকতে পারেনি। মর্মবেদনায় পুড়েছে দেশের অগণিত ক্রিকেট অনুরাগী।
কিন্তু সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত এবারের আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের মঞ্চ যেন অন্যরকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি পচেস্ট্রমের মাঠে বাংলাদেশের জুনিয়র টাইগাররা রচনা করে নতুন ইতিহাস। প্রথমবারের মত উঁচিয়ে ধরে বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি।
বিদেশের মাটিতে বড় বড় দলের সামনের এবারের বাংলাদেশ দল ছিল অন্যান্য বড় দলগুলোর মতই শক্তিশালী, নির্ভীক এবং ভয়ংকর। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এমনকি স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে কোন ম্যাচ না হেরে অপরাজেয় বাংলাদেশ ফাইনালে জয় ছিনিয়ে নেয় বর্তমান চ্যাম্পিয়ান ভারতে কাছ থেকে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সেরা পাঁচে মুশফিক।https://sonalikantha.com/বিশ্বের-সেরা-পাঁচে-মুশফি/
এতটা আত্মবিশ্বাস, দলের প্রতিটি খেলোয়ারের এমন জয়ের নেশা বেশ আশা জাগানিয়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের জন্য। আর এসব সম্ভবের পেছনে সবথেকে বড় অবদান রেখেছেন দলের অধিনায়ক। নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলকে গুছিয়েছেন, বিপদে হাল ধরেছেন। বাংলাদেশকে দিয়েছেন মনে রাখার মত ইতিহাস।
যাকে নিয়ে এত কথা সেই নেপথ্যের মানুষটি কে? কে এই অধিনায়ক? ক্রিকেটার আকবর আলীর জীবনের গল্প।
শৈশবে বেড়ে উঠা
রংপুর সদরের এক সাধারণ পরিবার। ২০০১ সালের ৮ই অক্টোবর বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা এবং মা সাহিদা বেগমের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন পরিবারের সব থেকে কনিষ্ট সদস্য হিসেবে। আকবর আলী বড় হয়েছেন পাঁচ বড় ভাই-বোনের আদরে।
ছোটবেলায় পড়েছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিশু নিকেতন স্কুলে। পরবর্তিতে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজে। ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড আগ্রহ খেলার প্রতি। খেলা বুঝে উঠার আগেই ব্যাট বল নিয়ে পড়ে থাকতেন আকরব। বয়স যখন মাত্র ছয় তখন থেকেই খেলা শুরু পাড়ার অলিতে গলিতে। খেলার প্রতি প্রচন্ড আকর্যণ দেখে বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা বাধা দেননি কখনো।
বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্মাদনার এক নিদর্শন এ দেশের সাকিব, তামিম, মুশফিক অথবা আকবরের মত ক্রিকেটারের বাবা, মা। তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় কখনো নিষেধ করেছেন, কখনো আটকে রেখেছেন। কিন্তু সন্তানের এগিয়ে যাবার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াননি। ক্রিকেটার আকবর আলীর জীবনের গল্প।
বাবা মোস্তফা রংপুরের একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী। মহানগরীর পশ্চিম জুম্মাপাড়ার গ্রাম হনুমানতলা। সেখানেই ব্যবসা করেন বাবা। ছেলের উৎসাহে এবং এলাকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী আলতাব হোসেনের পরামর্শে আকবরকে ভর্তি করেন রংপুর জেলা স্কুল মাঠের অসীম মেমোরিয়াল ক্রিকেট একাডেমিতে। সেই ছয় বছর বয়স থেকেই শুরু হয় আকবর আলীর ক্রিকেটের সাথে সখ্যতা, ভালোবাসা।
ক্রিকেট একাডেমির সেই ছোট্ট আকবর আজকের বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলের অধিনায়ক হয়েছেন। যার শুরুটা হয়েছিল একাডেমির কোচ অঞ্জন সরকারের হাত ধরে। শৈশবের তিনটি বছর প্রশিক্ষণ নেন সেই একাডেমিতে।
বিকেএসপিতে আকবর
২০১২ সালের দিকে চান্স পেয়ে যান দেশের প্রসিদ্ধ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিকেএসপি। যেখান থেকে আমরা পেয়েছি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে।
সাকিব আল হাসান যেমন আমাদেরকে দিয়েছেন ক্রিকেটের অসংখ্য স্বরণীয় মূহুর্ত, আকবর আলীও সেই একি পথে হেঁটে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আমাদের দিয়েছেন একটি কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ।
আকবর আলী ষষ্ট শ্রেণীতে থাকাকালীন চান্স পেয়ে যান বিকেএসপিতে। সেখানেই লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রিকেটের সাধনা। খেলার সাথে সাথে পড়াশোনাটাকে কখনো ছাড় দেননি। সমান তালে চালিয়ে গেছেন। ২০১৬ সালে সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে অর্জন করেন জিপিএ-৫। পরবর্তিতে ২০১৮ সালে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পান জিপিএ ৪.৪২।
আরও পড়ুনঃ এসএসসিতে এ+ পাওয়া ছাত্র আকবর।https://www.prothomalo.com/sports/article/1639141/এসএসসিতে-এ-প্লাস-পাওয়া-ছাত্র-আকবর
আকবর আলী প্রথম লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে। সেটা ২০১৯ সালের ৮ই মার্চ। প্রতিপক্ষ ছিল আবাহনী লিমিটেড। টি-২০ তে অভিষেক অবশ্য আরো মাসখানেক আগে। ২০১৯ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি অভিষেক ঘটে প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে। দুটি টি-২০ ম্যাচে করেছেন ৮৫ রান। সর্বোচ্চ রানও ৮৫। এখন পর্যন্ত খেলে ফেলেছেন ১৩টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ। যার মধ্যে তার মোট সংগ্রহ ২৯৫ রান।
অধিনায়কত্ত্বের দায়িত্ব
আকবরের নেতৃত্বগুণ অসাধারণ। সেটা উপলব্ধি করতে পেরে টিম ম্যানেজমেন্ট তার হাতে তুলে দেন অধিনায়কত্বের গুরুভার। আত্মবিশ্বাসী তো ছিলেনই তার উপর অধিনায়কের ভার কাঁধে আসায় হয়েছেন আর পরিণত। বিশ্বকাপ শুরু আগে টানা দুই বছর করেছেন পুরো দলের সাথে কঠোর পরিশ্রম। নিজেদের অবস্থান বুঝেছেন। লড়াই করার মানসিকতা এনেছেন খেলায়।
সবাই যখন একই আলোচনায় যে, বাংলাদেশের যুবারা এবার বিশ্বকাপে কেমন পারফর্ম করবে, আন্ডার ডগ হিসেবেই থাকবে নাকি ভালো কিছু ফলাফল এনে দেবে। এসব চিন্তার ধারের কাছে না গিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর আগে তিনি বলেন, ‘’বাংলাদেশ শুধু নক আউটেই যাবে না, বিশ্বকাপও জিতবে।‘’
যেখানে বাংলাদেশ কখনো ফাইনালেই পৌঁছাতে পারেনি তারা জিতবে বিশ্বকাপ। তাই এই ঘোষণা গণমাধ্যমে পায়নি কোন গুরুত্ব। কিন্তু আকবর আলীর দল কথা রেখেছে। শুধু বিশ্বকাপই জেতেনি। পুরো ট্যুর্নামেন্টে ছিল অপরাজিত। লিগ পর্যায়ে গ্রপের অন্য দলগুলো ছিল পাকিস্থান, স্কটল্যান্ড এবং জিম্বাবুয়ে।
দল হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে একসাথে খেলার ফল পেয়েছেন পুরো ট্যুর্নামেন্ট জুড়ে। সেমিফাইনালে হারিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মত শক্ত প্রতিপক্ষকে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) দলীয় সাফল্যে সাহায্য করেছে অনেক। বিদেশ সফর থেকে শুরু করে প্রচুর ম্যাচের আয়োজন করেছে বিসিবি। উন্নত অবকাঠামো তৈরীর ফলাফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। ব্যাটিং অলরাউন্ডার আকবর এভাবেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন দলের এবং বোর্ডের প্রতি।
শোক থেকে শক্তি
কিন্তু বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়টা একদমই অনুকূলে ছিল না অধিনায়কের। ২৪শে জানুয়ারী আকবরের বোন মারা যান যমজ সন্তান প্রসবকালীন সময়ে। এই ঘটনায় প্রচন্ড আহত হলেও দলের সদস্যরা সাহস যুগিয়ে গেছেন। বাড়ি থেকে আট হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা এই অধিনায়ক শোককে শক্তিতে পরিণত করে ফাইনালে খেলেছেন জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৩ রানের কার্যকরী ইনিংস। মাঠের বাইরের জীবন, মাঠের ভেতরের দ্বায়িত্ববোধ তাকে পরাজয়কে সামলাতে এবং জয়কে উদযাপন করতে শিখিয়েছে।
বিশ্বকাপ জয়ের পর মা সাহিদা আক্তার বলছিলেন, আকবরের হাত ধরে বিশ্বকাপ এসেছে বাংলাদেশের মাটিতে। এটা রংপুর তথা সারা দেশের জন্য আনন্দের, গর্বের।
প্রত্যাশা এবং ভবিষ্যৎ ক্রিকেট
শিরোপা জিতলেও মাটিতেই পা আকবরের। সফরের যে মাত্র শুরু তা তিনি ভালো করেই জানেন। দলের বাকিদের হয়ে বলেন, ‘’আমাদের আরো দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। সিনিয়র লেভেলের ক্রিকেটের সাথে অনেক পার্থক্য থাকলেও আমরা চেষ্টা করছি গ্যাপটা দূর করতে। এবং যতটা দ্রুত সম্ভব আমরা আমাদের টার্গেটে পৌছাতে চাই।‘’
উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান আকবর আলীর মধ্যে অনেকে দেখে ধোনির ছায়া। যেটাকে তিনি বড্ড বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। তিনি চান নিজের মত করে খেলতে। দেশের হয়ে আরো বিশ্বকাপ জেতাতে, দেশের মানুষকে সোনালী ট্রফির স্বাদ জাতীয় দলের হয়ে পাইয়ে দিতে।
রংপুরের এই সাধারণ তরুণ আজকে বাঙলার গর্ব। পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পেরেছেন বাংলার ক্রিকেটের ভিত এখন শক্ত। যে কোন পর্যায়ে বাংলাদেশের হয়ে সেরাটা বের করে আনাই এখন মূল দায়িত্ব। দেশের ঘরে ঘরে ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ুক। আমরা যেন পাই জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপের ট্রফি। আর দেশের ক্রিকেটে আসুক আকবরের মত এমন ক্রিকেটার। যারা আমাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের বিশ্বাস এখন দেশের যুবাদের হাতে। এগারোজন আকবরের হাতে।
লিখেছেন রাজন রায়