রহস্যঘেরা আরব নগরী পেত্রা সম্পর্কে জেনে অবাক হবেন। আজকে আমরা জানব প্রাচীন আরব নগরী পেত্রা সম্পর্কে।স্থানীযদের কাছে এটি রাকুম নামে পরিচিত। পেত্রা নগরীটি সম্পূর্ণ পাথর বেষ্টনী সমৃদ্ধ।তাই সারা বিশ্বে আরবের পেত্রা নগরী রহস্যঘেরা এবং আকর্ষণীয়।পেত্রা নগরী সম্পর্কে আপনারা অনেকেই হয়ত শুনেছেন।আজকে আমরা পেত্রা নগরী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরব আপনাদের জানার স্বার্থে।
পেত্রা একটি গ্রীক শব্দ।এর অর্থ হলো পাথর।এই জায়গাটি লোহিত সাগর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে।জর্ডানের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি গ্রাম ওয়াদি মুসার ঠিক পূর্বে।জাবাল আল মাদরা পাহাড়ের নিচে অবস্থিত।এক সময় নগরিটি খুব সুন্দর সুরক্ষিত একটি দূর্গ ছিলো।যার চারদিকে উঁচু পাহাড়ি দেয়াল।কিছু দূর পরপর বর্গাকার গোলাকার উঁচু স্তম্ব।পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা পাথরের কারুকাজ।পাহাড় কেটে কেটে সুনিপুন ভাবে সুন্দর আকর্ষণীয় রুম গুলো সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বেশ আকর্ষনীয়।প্যলিওলিথিক ও নিওলিথিক যুগের ভগ্নাবশেষ পেত্রায় আবিষ্কৃত রয়েছে।
এক সময় পাথরে ঘেরা উঁচু পাহাড় গুলোতে প্রচুর ঝর্ণাও ছিলো।পেত্রা নগরীর মূল গুহার ঠিক পাশেই রয়েছে পাহাড়ের উপর কারুকাজ করা দালান গুলো।এই নগরীতে রয়েছে পুরনো একটি মন্দির যা ধনভান্ডার হিসেবে ব্যবহার করা হত।বিনোদন এর জন্য পেত্রা নগরীতে স্টেডিয়ামের মত গোলাকার একটি মাঠ রয়েছে।এইটা কেউ আবার নাট্যশালা বলে থাকেন।এই নাট্যশালায় প্রায় তিন হাজার দর্শক একসাথে বসতে পারবে।
নগরীটি এমন সুবিধাজনক জায়গায় ছিলো যেখান থেকে পশ্চিমের গাজা উত্তরে বসরা ও দামেস্কো,মৃত বা লোহিত সাগরের পাশে আকুয়াবা ও লিউস সহ মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগর যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারত পেত্রারা। মূলত এ্ই কারনে জায়গাটি অর্থনৈতিক ভাবে বেশি সমৃদ্ধ এবং নিরাপত্তার দিক দিয়েও অনেক সুরক্ষিত ছিলো।
খ্রীষ্ট পূর্ব ৪০০ থেকে খ্রীষ্ট পূর্ব ২০০ পযন্ত এটি আরবের নাবতীয় রাজ্যের রাজধানী। তখন থেকে নগরীটি সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ নগরী রুপে ছিলো।পেত্রারা সবথেকে শক্তিশালী ছিলো।পরবর্তিতে রোমান শাসনের সময় রোমানরা সমুদ্র কেন্দ্রিক বাণিজ্য শুরু করলে পেত্রাদের আধিপত্য কমে যায়।তারপর থেকে পেত্রারা অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে।এবং ১০৬ খ্রিস্টাব্দে এসে রোমনরা তাদের পেত্রায়া রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলে।দ্বিতীয় তৃতীয় শতকে কিছুটা উন্নতি সাধিত হলেও পরবর্তিতে পেত্রার প্রতিদ্বন্ধী শহর পামিরা পেত্রাদের অধিকাংশ বাণিজ্য দখল করে নেয়।ফলে পেত্রার গুরুত্ব একেবারেই কমে যায়।
আরও পড়ুনঃ সুদানের মৃত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সন্ধান। https://sonalikantha.com/সুদানের-মৃত-প্রতিরক্ষামন/
সপ্তম শতকের দিকে মুসলমানরা এটিকে দখল করলেও দ্বাদশ শতকে ক্রুসেডররা এটিকে দখল করে নেয়।এভাবে সময়ের ব্যবধানে যুদ্ধ বিদ্রোহ আর প্রাকৃতিক ঝড় তুফান এর মুখোমুখি হয়ে পেত্রা নগরী এক সময় প্রায়ই ধ্বংস হয়ে যায়।মধ্যযুগে এসে পেত্রার ধ্বংসাবশেষ আবার মানুষের কাছে আকর্ষনীয় হতে থাকে।ত্রয়োদশ শতকে মিশরের সুলতান বাইবার্স পেত্রার ধ্বংসাবশেষ দেখতে যান।পেত্রার রাস্তা দিয়ে উটের পিঠে করে চিনের সিল্ক আর ভারতের মশলা ও সুগন্ধী এক দেশ থেকে আরেক দেশে আনা নেওয়া হত।
এরকম ব্যবসার সুবাধে তারা একসময় ধনী জাতিতে পরিণত হয়েছিলো।শুধু অর্থ কড়ি নয় বানিজ্যিক সূত্রে পরিচতি হওয়ায় মিশরীয়, রোমানয়িান, ফেলেনিস্টিক ও সিরীয় সব ধরনের স্থাপত্য নির্মাণে তাদের অসাধারণ পারদর্শিতা ছিলো।পাহাড় এবং পাথর যেন এই সম্রাজ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।শহরের বাড়ি সমাধী,মন্দির তিনটি ঘেরা বিশাল উন্মুক্ত মঞ্চ,মার্কেট আর কিছু দূর পরপর সুউচ্চ স্তম্ব।সবকিছু তৈরী হয়েছে পাহাড়ি বেলে পাথর কেটে কেটে।
পানি ছাড়া কোন শহরই টিকে থাকতে পারেনা ।পেত্রা নগরীতে ২০০০ বছর আগেও এতটাই উন্নত ছিলো যা কিনা আধুনিক যুগের মানুষরা মাত্র কয়েক শতাব্দি আগে জানতে পেরেছে।পেত্রার পার্শবর্তি শহর ওয়াদি মুসার ৮টি ঝর্ণার মধ্যে একটির সুসমন্বিত ২৫ মাইল দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন বেয়ে এ্ই পানি নগরীর প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে যেত।পেত্রা নগরীর মাটির নিচ জুড়ে আজও জালের মত ছড়িয়ে আছে সেই পানির পাইপ।আর এছাড়াও আরও ছিলো পানি জমিয়ে রাখার জন্য ছত্রিশটা সুউচ্চ বাঁধ।প্রতিটি বাড়ির সামনে ছিলো সবুজ খেজুরের উদ্যান।
পেত্রার সমাধি গুলোর অনেক গুলো বিস্তৃত মুখ রয়েছে এবং এটি ঘরের মত ব্যবহার করা হয়। এসব মন্দির ও স্মৃতিসৌধ প্রাচীন এই শরের সামাজিক,রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারনা দেয়।
হঠাৎ একদিন বিশ থেকে ত্রিশ হাজার অধিবাসী নিয়ে এই সমৃদ্ধ শহর হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।পরিণত হয় “দ্যা লস্ট সিটি’তে”।প্রত্নতত্ত্ববিদ গণের মতে ৩৬৩ সনের এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে এই শহর ধ্বংস হয় এবং হারিয়ে যায়।৫২০ খ্রিষ্টাব্দে এই শহরে দ্বিতীয় বার ভূমিকম্পে আঘাত হানে।
১৮১২ সালের আগে এই শহর পশ্চিমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো।সুইস অভিযাত্রী জোহান লুডিগ বারখাট এই হারানো শহরটির সন্ধান পান।সুইস এই অভিযাত্রী বারখাট বেদুইনদের মুখ থেকে হারানো এক শহরের গল্প শুনে এবং প্রাচীন ম্যাপ মিলিয়ে সেই শহরের খোঁজে এক অভিযানে বের হয়।বারখাট তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে পেত্রা শহরটি খুঁজতে লাগলো।দিনের পর দিন তারা হাঁটতে লাগলেন।
একদিন তারা মরুভূমি থেকে দেখতে পেলেন একটি গিরিখাত।সেই গিরিখাতের চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় মাঝখানে রাস্তা।সেখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বারখাটের চোখে পড়লো পাথরের একটি ভবন।অবশেষে ১৮১২ সালে তিনি এটি খুঁজে পান।শহরটি সহজে খুঁজে না পাওয়ার আরেকটি কারন ছিলো শহরটি অসাধারণ সুরক্ষিত পাহাড় ঘেরা বৈশিষ্ট্য।আজকের আধুনিক যুগে এসেও শহরটিতে কোন রকম যানবাহন প্রবেশ করতে পারেনা।প্রবেশের মাধ্যম হলো হেঁটে যাওয়া বা উঁটের কাফেলা।এই নগরীতে প্রবেশের একমাত্র পথ হলো এক কিলোমিটার খাড়া এক গিরিপথ।
জন উইলিয়াম বার্গান তার “নিউডিগেট” পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত এক সনেটে এই পেত্রা নগরীকে বর্ণনা করে লিখেছেন, “A rose-red city half as old as time”. পেত্রা সংস্কৃতি,সম্পদ,ঐতিহ্য আর ক্ষমতায় কতটা উন্নত ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় এর ধ্বংসাবশেষ দেখিই।ইউনেস্কো একে “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ গোষণায় বলে, “One of the most precious cultural properties of man’s cultural heritage”.রহস্যঘেরা আরব নগরী পেত্রা সম্পর্কে জেনে অবাক হবেন।
জেরুজালেমের ব্রিটিশ স্কুল অব প্রত্নতত্ত্বের পক্ষ্যে ১৯৮৫ থেকে পেত্রার খনন শুরু করে এবং পরে আমেরিকান সেন্টার অফ অরিয়েন্টাল রিসার্চ যুক্ত হয়।প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেত্রার অর্ধেকেরও কম অনুসন্ধান করেছেন।২০১৬ সালে উপগ্রহের তোলা ছবিতে দেখা যায় একটি বিশাল বিস্ময়কর কাঠামো এখনও বালির নিচে চাপা পড়ে আছে।
১৯৮৯ সালে চলচ্চিত্র ইন্ডিয়ানা জোনস এর বিখ্যাত চলচ্চিত্র “দ্যা লস্ট ক্রুসেডে” এই নগরীর দৃশ্য দেখানো হয়েছিলো। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে ভূমিকম্পের অনেক আগেই এই শহরের অধিকাংশ আধিবাসী মারা যান।কারন ভূমিকম্পের আরও গভীরে পাওয়া গেছে মানুষ ও হাড়গুড়ের স্তর।
১৯৮৫ সালে পেত্রাকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দেশ বিদেশের আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে আমাদের ওয়বেসাইট নিয়মিত ভিজিট করুন এবং আর্টিকেল গুলো শেয়ার করুন।