সোনাগাজী (ফেনী) প্রতিনিধিঃ
আন্দোলনে অংশ না নিয়েও ‘আহত জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয় নিয়েছেন ফেনীর সোনাগাজীর এনায়েত উল্যাহ বাপ্পী (২৬) নামের এক কাঠমিস্ত্রি। ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে আহত হলেও তিনি পরে দাবি করেন, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট মহিপালে ছাত্রজনতার আন্দোলনে আহত হয়েছেন। অথচ ওই সময় তিনি সুস্থ শরীরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ছিলেন। এরপরও সরকারি গেজেটে তিনি “জুলাইযোদ্ধা” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নানা সুবিধা ভোগ করছেন। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এনায়েত উল্যাহ বাপ্পী সোনাগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব সুজাপুর গ্রামের আনোয়ার আলী সারেং বাড়ির আহসান উল্যার ছেলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই ফেনী শহরের ইসলামপুর সড়কে পুলিশ ও বিএনপি নেতা–কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় পথচারী হিসেবে পুলিশের গুলিতে আহত হন এনায়েত উল্যাহ বাপ্পী। সে সময় ঘটনাটি স্থানীয় দৈনিক ফেনীর সময় পত্রিকা ও তার নিজেসহ কয়েক জনের ফেসবুক আইডিতেও ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর এনায়েত উল্যাহ বাপ্পী নিজেকে আন্দোলনের আহত দাবি করে এক ছাত্রনেতার সহায়তায় ফেনী সিভিল সার্জন অফিসে গিয়ে আহত তালিকায় নাম লেখান। পরে সরকারি গেজেট নম্বর ৪২৫, তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ অনুযায়ী তিনি “জুলাইযোদ্ধা” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
২০২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এনায়েত বাপ্পি একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দেন। তিনি দাবি করেন, ২০২৪ সালে ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ৩০টি গুলির স্প্লিন্টার লাগার পরও ফেনীতে চিকিৎসা না নিয়ে ঘটনার ১০দিন পর ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছেন বলে দাবি করেন। তবে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রমাণ সাংবাদিকদের দেখাতে পারেননি তিনি।
অন্যদিকে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ওই সময় তার বিয়ের আয়োজন চলছিল। ৪ আগস্ট ছিল গায়ে হলুদ এবং ৫ আগস্ট তিনি বিয়ে করেন আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের আবদুল হকের মেয়ে উম্মে কুলছুম তারিনকে। যা ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। সুস্থ শরীরে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার প্রমাণ থাকলেও আন্দোলনে আহত হওয়ার কোনো তথ্য বা নথি মেলেনি।
আহত দাবি করা এনায়েত বাপ্পির প্রতিবেশী মোঃ রুবেল বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছিলো তার দ্বিতীয় বিয়ে। আমরা দেখেছি, ৪ আগস্ট ছোট পরিসরে তার বাড়িতে বিয়ের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এনায়েত বাপ্পি তখন সুস্থ ছিলো। সে সুস্থ না থাকলে কি গায়ে হলুদ ও বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে পারতো?
এর আগে ২০২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিন সাংবাদিকসহ ১০৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। তবে পরদিন (১৮ সেপ্টেম্বর) মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয় ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রভাব খাটাচ্ছেন ও চাঁদাবাজি করছেন।
এনায়েত উল্যাহ বাপ্পীর বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তি নিয়ে এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃত আন্দোলনকারীরা বঞ্চিত হলেও সুযোগ নিচ্ছেন এমন ব্যক্তিরা, যারা বাস্তবে আন্দোলনে অংশ নেননি।
সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের সুজাপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার বেলায়েত হোসেন বেলু বলেন, ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই ফেনীর জহিরিয়া মসজিদের সামনে পুলিশ ও বিএনপি নেতা–কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় এনায়েত বাপ্পি আমার সামনে ছররা গুলিতে আহত হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে তার বিয়ের দিন তাকে আমরা সুস্থ দেখেছি। মুলত এক সময় কাঠমিস্ত্রি কাজ করে সংসার চালানো বাপ্পি এখন লাখ লাখ টাকার মালিক। এখন আর কাজ করেন না। অথচ তারই ছোট ভাই হৃদয় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ও গত ৮ মে মাসে আওয়ামী লীগের ফেনীতে ঝটিকা মিছিলের নেতৃত্ব দেন।
২০২৩ সালের আন্দোলনে যুক্ত থাকা জসিম বাবুর্চি পুলিশের গুলিতে আগত হোন। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে পুলিশ গুলি ছুড়লে আমি ও বাপ্পি একই সাথে আহত হই। ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট সে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, বিজয় উল্লাস উদযাপনে আমরা ফেনী ছিলাম তখন সে বিয়ে পিড়িতে তার চাচা দুলাল সহ ছিলো। তখন আমি তার চাচাকে ফোন দিয়ে বলি বিয়ে থেকে দ্রুত ফেনী আসতে।
ফেনীর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যতম সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘গত বছরের ৪ আগস্ট মহিপালে ছাত্র আন্দোলনের আহত দাবি করে অনেকে মামলা করার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আসামিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাদের পরিবারের কাছে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণিজ্য করা।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, ‘ফেনীতে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ নিরপরাধ লোকদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজীর কিছু ছেলে আমাদের দলের নাম ভাঙিয়ে মামলা বাণিজ্য করছে। আমরা এ ব্যাপারে সব সময় প্রতিবাদ করছি।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিভিল সার্জন অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্দোলনের পরপর এক ছাত্রনেতার মাধ্যমে নিজেকে আহত দাবি করে জোরপূর্বক তালিকায় নাম তুলেছেন। এ সময় তিনি শরীরের আঘাতের চিহ্ন ও ছবি দিয়েছেন। তবে তা কবের, তা যাচাই-বাছাই করা হয়নি।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনায়েত উল্যাহ বাপ্পী গণমাধ্যম কে বলেন, ‘২০২৪ সালের ৪ আগস্ট গায়ে হলুদের আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। আর ৫ তারিখ সাধারণভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সেদিন আহত হওয়ার পর নিজেই স্ত্রীর সেফটি-পিন দিয়ে শরীরে থেকে বুলেট বের করেছি। এখনও শরীরে স্প্লিন্টার আছে। ব্যথা বেদনা আছে। প্রথমে আত্মীয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা করি।’
পরে ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন দাবি করলেও হাসপাতাল ও চিকিৎসকের নাম বলতে পারেননি বাপ্পী। মামলা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মামলাতে সাংবাদিকদের নাম আসায় মামলাটি নিয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ হয়েছে। এখন জুলাইযোদ্ধা হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে আবার মামলা করব।’
জুলাই আন্দোলনে অংশ না নিয়েও কীভাবে জুলাইযোদ্ধা হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফেনীর সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ রুবাইয়াত বিন করিম বলেন, ‘আন্দোলনের পর তৎকালীন সিভিল সার্জন তার শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখে হয়তো তালিকাভুক্ত করেছেন। বিষয়টি আমি জানি না।’