নিজস্ব প্রতিবেদক:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কারের আলোচনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থানে অনেকটাই সাদৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু জুলাই সনদে জামায়াতের স্বাক্ষর করা এবং এনসিপির স্বাক্ষর না করার পর সেই চিত্র হঠাৎ বদলে গেছে।
জামায়াতের বিরুদ্ধে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। গত এক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে ‘সুসম্পর্ক’ দেখা গেলেও এখন এনসিপি কেন জামায়াতের সমালোচনা করছে, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করা না করার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।
এনসিপির অবস্থান হচ্ছে, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত হওয়ার আগে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না দলটি। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে এর আগে অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করেছে তারা। এনসিপি নেতাদের চাওয়া ছিল, জামায়াতসহ আরও কিছু দল সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে না যাক।
নাহিদের ফেসবুক পোস্টে কী আছে
জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘পিআর’ আন্দোলন একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল রোববার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে নাহিদ লিখেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত প্রশ্ন থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং জাতীয় সংলাপকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল।
জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে ভোট করার যে আন্দোলন জামায়াত এখন করছে, সেটিকে ‘কথিত’ আন্দোলন বলেও উল্লেখ করেন এনসিপির শীর্ষ এই নেতা। তিনি লিখেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি জামায়াত। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি, কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।
নাহিদ লিখেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীন সংস্কারের বিষয়ে দলটি (জামায়াত) আকস্মিক যে অনুমোদন দিয়েছে, সেটা সংস্কার আকাঙ্ক্ষার ফল নয়; বরং একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ। সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে এটি একটি রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত।
জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টটি নাহিদ লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়। দলটি সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত ও তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে। তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
‘বিশ্বাসভঙ্গের বোধ’
এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কেউ এর আগে প্রকাশ্যে জামায়াতের তীব্র সমালোচনা করেননি। জামায়াত নিয়ে হঠাৎ নাহিদের এমন পোস্টের কারণ কী, তা জানতে এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পাঁচজন নেতার সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, সংস্কার প্রশ্নে জামায়াতকে ‘গুড ফেইথে’ (বিশ্বাসের সঙ্গে) গ্রহণ করেছিল এনসিপি। বিশেষ করে সংস্কার ও বিচারের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য ছিল।
কিন্তু জামায়াতের দিক থেকে এনসিপির তৃণমূল পর্যায়ে অনুপ্রবেশ করে স্যাবোটাজ (অন্তর্ঘাত) ঘটানোর চেষ্টা আছে বলে মনে করছেন ওই নেতারা। তাঁরা বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাসহ জামায়াতের সাম্প্রতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে এনসিপির মধ্যে একধরনের ‘সেন্স অব বিট্রেয়াল’ (বিশ্বাসভঙ্গের বোধ) তৈরি হয়েছে। সে কারণেই জামায়াতের ‘রাজনৈতিক দ্বিচারিতার’ বিষয়টি এখন জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চাইছেন তাঁরা।
পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াতের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলছে, সেখানে এনসিপিকেও রাখার চেষ্টা ছিল। কিন্তু কিছু দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ায় এনসিপি শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনে যুক্ত হয়নি।
এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা চাইছেন তাঁরা। এত দিন জেনে এসেছেন, বিএনপি এ ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করছে। কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁরা জানতে পেরেছেন, এনসিপি যাতে শাপলা প্রতীক না পায়, সে ক্ষেত্রে জামায়াতও বাধা সৃষ্টি করছে। জামায়াতের কড়া সমালোচনা করে নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্টের পেছনে এটিও কাজ করে থাকতে পারে। এর পাশাপাশি এখানে এনসিপির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের বিষয়টিও রয়েছে।
জামায়াতের সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে বক্তব্য জানতে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।
নাহিদের পোস্ট এবং জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বড় দলগুলো তাদের দ্বিচারিতার পুরোনো কৌশলকে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখাতে চায়। এই চতুরতা যে ভালো কিছু নয়, সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তাঁরা।
জামায়াত কী বলছে
নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট ‘অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল রোববার রাতে আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে দলটি বলেছে, নাহিদ ইসলামের কাছ থেকে বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গণমাধ্যমে এই বিবৃতি পাঠিয়েছেন। এতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। জামায়াতে ইসলামীর পিআর দাবির আন্দোলনকে প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক কৌশল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা এহসানুল মাহবুব ওই বিবৃতিতে বলেন, ‘তিনি (নাহিদ ইসলাম) তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তাঁর কাছে এই ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।’
বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এবং রাজপথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিজেদের দৃঢ় অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। কাজেই নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই।
নাহিদ ইসলামকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব।