×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-০৯-৩০
  • ১৬১ বার পঠিত

মো: নুরুদ্দীন শেখ :


বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার জালে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, জনগণের আস্থা এখন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। সরকারি বরাদ্দ প্রতিবছর বেড়েছে, কিন্তু সেই বরাদ্দের বড় অংশই অপচয় বা দুর্নীতির কবলে পড়ে। এতে একদিকে করদাতাদের অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা থেকে।


ওষুধ কেনায় অস্বচ্ছতা ও কমিশন বাণিজ্য

সরকারি হাসপাতালে প্রতি বছর প্রায় ১২-১৫ হাজার কোটি টাকা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় ব্যয় হয়। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকায় ঘুষ ও কমিশন নির্ভর সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

সূত্র: টিআইবি’র গবেষণা (২০২৩) অনুযায়ী, সরবরাহকারীরা গড়ে ২০-২৫% পর্যন্ত কমিশন প্রদান করে কাজ আদায় করে থাকে। এতে নিম্নমানের ওষুধ ও যন্ত্রপাতি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ হয়।

কক্সবাজার জেলা হাসপাতালের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—
“আমাদের অনেক সময় এমন ওষুধ দেয়া হয় যা ব্যবহারযোগ্য নয়, অথচ কাগজে দেখানো হয় আন্তর্জাতিক মানের। ব্যবহারের আগেই সেগুলো অচল হয়ে পড়ে।”


ভুয়া ডাক্তার ও অনুমোদনহীন ফার্মেসির দৌরাত্ম্য

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) জানিয়েছে, দেশে হাজার হাজার ভুয়া ডাক্তার চেম্বার খুলে বসেছে। এরা কোনো ডিগ্রি ছাড়াই প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে, এমনকি ছোটখাটো অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছে।

অন্যদিকে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (DGDA) ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৪০% ফার্মেসি অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে। ফলে ভুল ওষুধ ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর শত শত রোগী জটিলতায় ভোগে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন—
“আমার স্বামীকে জ্বরের জন্য পাশের এক ভুয়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তিনি যে ওষুধ দেন তা খেয়ে উল্টো অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। পরে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।”


সরকারি হাসপাতালে ভোগান্তি ও ঘুষের সংস্কৃতি

সরকারি হাসপাতালের ভেতরে দুর্নীতি যেন দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রোগী ভর্তি করাতে ঘুষ দিতে হয়।

অপারেশন বা আইসিইউতে জায়গা পেতে টাকা দিতে হয়।

হাসপাতালের বরাদ্দকৃত ওষুধ ও খাবার প্রায়শই রোগীদের কাছে পৌঁছায় না।

সূত্র: মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিবেদন (২০২২) ও দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৫ জুন ২০২৪।

ঢাকার মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা জসিম উদ্দিনের স্বজন বলেন—
“ডাক্তারের কাছে ঢোকার আগেই ওয়ার্ডবয় ৫০০ টাকা চাইলো। না দিলে সেবা পাওয়া যায় না।”


দুর্নীতির টাইমলাইন

২০১৫: বাজেট ২৭ হাজার কোটি টাকা, অনিয়ম ধরা পড়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার (সূত্র: মহা হিসাব নিরীক্ষক, ২০১৬)।

২০২০: কোভিড-১৯ কেলেঙ্কারি—মাস্ক, পিপিই, কিট কেনায় কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি (সূত্র: প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০২০)।

২০২৩: টিআইবি প্রতিবেদন—স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তালিকায় শীর্ষে (সূত্র: টিআইবি, ডিসেম্বর ২০২৩)।

২০২৫: DGDA রিপোর্ট—দেশের প্রায় ৪০% ফার্মেসি অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট ছাড়া চলছে।


পরিসংখ্যান এক নজরে

স্বাস্থ্য খাতে বাজেট (২০২৪-২৫ অর্থবছর): ৮৩,০০০ কোটি টাকা (সূত্র: জাতীয় বাজেট ২০২৫)।

সরকারি হাসপাতালের ৬০% রোগী অভিযোগ করেছেন, তারা বরাদ্দকৃত ওষুধ পাননি (সূত্র: টিআইবি জরিপ, ২০২৩)।

৭৩% মানুষ জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে (সূত্র: টিআইবি জরিপ, ২০২৩)।


বিশেষজ্ঞ মতামত

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন—
“স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং জনগণের জীবন নিয়ে এক ধরনের অপরাধ।”
(সূত্র: টিআইবি প্রেস ব্রিফিং, ডিসেম্বর ২০২৩)

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন—
“ভুয়া ডাক্তার ও অনুমোদনহীন ফার্মেসি নিয়ন্ত্রণ না করলে জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।”
(সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)


উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম এখন কাঠামোগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাজেট বাড়লেও তা সাধারণ মানুষের সেবায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। স্বচ্ছ টেন্ডার ব্যবস্থা, ভুয়া ডাক্তার ও ফার্মেসির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান, এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই পারে এই খাতকে বাঁচাতে। অন্যথায় জনগণের করের টাকায় পরিচালিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেবল কাগজে-কলমেই থাকবে, বাস্তবে নয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat