নিউজ ডেস্ক:
জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর ট্রাম্পের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ যে গতিতে গণতান্ত্রিক চর্চাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে এবং সরকারের আদল বদলে দিচ্ছে তার প্রতিবাদ জানাতে এ কর্মসূচি ডাকা হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা ও লাগামছাড়া দুর্নীতির’ প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ‘নো কিংস’ বা ‘রাজা মানি না’ সমাবেশগুলোতে অংশ নিতে বিভিন্ন বয়সী লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ছোট বড় বিভিন্ন শহর ও মফস্বলে এরকম দুই হাজার ৬০০ সমাবেশ হওয়ার কথা বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।
জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর ট্রাম্পের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ যে গতিতে গণতান্ত্রিক চর্চাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে এবং সরকারের আদল বদলে দিচ্ছে তার প্রতিবাদ জানাতে এ কর্মসূচি ডাকা হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এসব বিক্ষোভ সমাবেশে ২০ থেকে ৩০ লাখ বা তারও বেশি মানুষ যুক্ত হবে বলে আয়োজকরা আশা করছেন, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
সব মিলিয়ে সমাবেশগুলোকে মনে হয়েছে উৎসবমুখর; বেশিরভাগ জায়গায় বাতাসে ফোলানো নানান খেলনা চরিত্র দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীদের অনেকের শরীরেও ছিল নানা ধরনের সাজপোশাক। বিক্ষোভে সব বয়সী সব বর্ণের মানুষের উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে। বাবা-মা’রা স্ট্রোলারে করে নিয়ে এসেছেন এখনও হাঁটতে না শেখা শিশুদের, তাদের পাশেই ছিলেন অবসরপ্রাপ্তরা, অনেকের সঙ্গে ছিল খাঁচায় রাখা পোষা প্রাণীও।
এসব সমাবেশে এখন পর্যন্ত বড় কোনো হাঙ্গামার খবর পাওয়া যায়নি।
“শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের অধিকারকে কাজে লাগানো এবং ‘আমাদের রাজা নেই’ বলার চেয়ে বেশি আমেরিকান আর কিছু হতেই পারে না,” বলেছেন প্রগতিশীল সংগঠন ইনডিভিজিবলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লিয়া গ্রিনবার্গ। শনিবার দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজনের পরিকল্পনা যারা করেছে, ইনডিভিজিবল তাদের নেতৃত্বে রয়েছে।
এদিন বিক্ষোভকারীদের ভিড়ে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার ভরে উঠেছিল। এক লাখের বেশি মানুষ শহরটির ৫টি প্রশাসনিক এলাকার সর্বত্র শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলেও পুলিশ বলেছে বিক্ষোভ সংশ্লিষ্ট একজনকেও আটক করতে হয়নি তাদের।
একইভাবে বোস্টন, ফিলাডেলফিয়া, আটলান্টা, ডেনভার, শিকাগো, সিয়াটলের সমাবেশগুলোতেও দেখা গেছে হাজার হাজার মানুষ।
পশ্চিম উপকূলে কেবল লস এঞ্জেলেসের আশপাশের শহরতলিগুলোতেই ডজনের বেশি সমাবেশ হয়েছে। সিয়াটলে বিক্ষোভকারীরা শহরতলি থেকে শুরু করে সিয়াটল সেন্টার প্লাজার মধ্য দিয়ে শহরটির বিখ্যাত স্পেস নিডলের আশপাশ পর্যন্ত এক মাইলের বেশি লম্বা পথ পূর্ণ করে ফেলেন।
স্যান ডিয়েগোতেও ২৫ হাজারের বেশি মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, বলেছে পুলিশ।
রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রে ট্রাম্প যেভাবে বিচার বিভাগকে কাজে লাগাচ্ছেন, অবৈধ অভিবাসীদের সামরিক কায়দায় দমনপীড়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ন্যাশনাল গার্ডের সেনা পাঠানোকে ঘিরে অনেক মার্কিনি, বিশেষ করে মতাদর্শগতভাবে বাম ঘরানার নাগরিকদের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি শনিবারের বিক্ষেোভে মূলত তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।
ট্রাম্প তার নীতিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে প্রশাসনজুড়ে যেভাবে অনভিজ্ঞ ও অনুগত লোকদের বসাচ্ছেন এবং গণমাধ্যম, ল’ ফার্ম ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে ধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছেন তা নিয়েও দিন দিন অসন্তোষ বাড়ছে।
শনিবারের সমাবেশগুলো ছড়ানো ছিটানো হলেও বেশিরভাগই ছিল সুশৃঙ্খল; পুলিশকে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিতে হয়নি।
ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন ক্যাপিটল ভবন অভিমুখে মিছিলের আগে এক সড়কে জমায়েত হওয়া বিক্ষোভকারীদের স্লোগান দিতে দেখা গেছে। তাদের অনেকর হাতে ছিল বিভিন্ন দাবিদাওয়া সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, কেউ কেউ মার্কিন পতাকা ও বেলুনও ওড়াচ্ছেন, মনে হচ্ছিল যেন কোনো উৎসব চলছে।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি টুপি পরা, হাতে ‘স্বৈরশাসক হওয়ার চেষ্টা নয়’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে সমাবেশে আসা অ্যালিস্টন এলিয়ট বলেন, “গণতন্ত্র এবং যা সঠিক তার জন্য লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন দেখাতে চাইছি আমরা। আমি ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে।”
হিউস্টনের শহরতলিতে সমাবেশে যোগ দেন মার্কিন মেরিন কর্পসের ভেটেরান ৩০ বছর বয়সী ডেনিয়েল অ্যাবোয়টি গামেজ। সিটি হলের এ সমাবেশে প্রায় ৫ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
“এই মুহূর্তে দেশে কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না আমি,” বলেছেন ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় দায়িত্ব পালন করা গামেজ।
অরেগনের পোর্টল্যান্ডে নদীতীরে হওয়া সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে দেখা গেছে ৭০ বছর বয়সী কেভিন ব্রাইসকে, তিনিও একসময় সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। তার লম্বা হাতার কালো শার্টে লেখা রয়েছে ‘নো কিংস সিনস ১৭৭৬’ স্লোগান, ওই বছরই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
“সামরিক বাহিনীতে থাকার সময় যেসব মূল্যবোধের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম বলে মনে হতো তার সবই এখন ঝুঁকির মুখে আছে বলেই মনে হচ্ছে। যদিও আমি আজীবনের রিপাবলিকান, কিন্তু দল এখন যেদিকে যাচ্ছে তাকে সমর্থন করতে পারছি না আমি,” বলেছেন ব্রাইস।
তেল শিল্পে দীর্ঘসময় কাজ শেষে অবসর নেওয়া ৭৪ বছর বয়সী স্টিভ ক্লপের মুখেও শোনা গেল একই সুর। তার পরনে থাকা শার্টে লেখা রয়েছে, ‘সাবেক রিপাবলিকান’।
“আমি সবসময় রিপাবলিকান। আমার পরিবারও সবসময় তাই ছিল। কিন্তু একজন কেউ আমাকে দল থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আমার,” বলেছেন তিনি।
ডেনভারের কলোরাডোতে অঙ্গরাজ্য পার্লামেন্টের বাইরে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩৮ বছর বয়সী কেলি কিনসেলা, পরণে ছিল লেডি লিবার্টির পোশাক, যার চোখ থেকে রক্তমাখা জল ঝরছিল।
“সবাই দুশ্চিন্তা নিয়ে কাজ করতে আসছে, এর কারণ বর্তমান পরিস্থিতি,” বলেছেন কিনসেলা। তিনি জানান, নতুন করে যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে তাই তাকে এই সমাবেশে আসতে উদ্ধুদ্ধ করেছে। আর এই মূল্যস্ফীতির জন্য তিনি ট্রাম্পের শুল্ক নীতিকেই দায় দিচ্ছেন।
ট্রাম্প এখন পর্যন্ত শনিবারের বিক্ষোভ নিয়ে তেমন কিছু বলেননি। তবে শুক্রবার ফক্স বিজনেসে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রসঙ্গে বলেছেন, “তারা আমাকে রাজা বলতে চাইছে, আমি রাজা নই।”
গত বছরের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জেরবার ডেমোক্রেটিক পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা, যেমন সেনেটের সংখ্যালঘু অংশের নেতা চাক শুমার ও তুখোড় প্রগতিশীল বক্তা খ্যাত মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ এই ‘নো কিংস’ আন্দোলনে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে একই ব্যানারে গত ১৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দুই হাজারের বেশি বিক্ষোভ হয়েছিল। সেদিন ছিল ট্রাম্পে প্রগতিশীল ৭৯তম জন্মদিন, ওইদিন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র বিরল এক সামরিক কুচকাওয়াজও করেছিল।
বেশিরভাগ রিপাবলিকান নেতাই এই ‘নো কিংস’ বিক্ষোভকে দেখছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে। শুক্রবার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসনের মুখেও একই সুর শোনা গেছে। তিনি বিক্ষোভকে বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা দেখানোর সমাবেশ’।
বেশিরভাগ রিপাবলিকান নেতাই বলছেন, বিক্ষোভের আয়োজকরা এমন এক পরিবেশ উসকে দিতে চান যেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা চরম আকার ধারণ করে। সেপ্টেম্বরে ডানপন্থি অধিকারকর্মী ও ট্রাম্পমিত্র চার্লি কার্ককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর এ ধরনের বিক্ষোভ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করবে বলেও তাদের আশঙ্কা।
শনিবার ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণে ক্যাম্প পেন্ডেলটনে মেরিনদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখা ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ‘নো কিংস’ বিক্ষোভ প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি। তিনি ‘শাটডাউন’ নিয়েই ডেমোক্রেটদের তুলোধুনো করেছেন। দলীয় বিভাজনের কারণে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা একমত না হওয়ায় মার্কিন সরকারের এ অচলাবস্থা টানা তৃতীয় সপ্তাহ পার করছে।
এ জাতীয় আরো খবর..