ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ :
বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস প্রতি বছর ২০ অক্টোবর পালিত হয়। এই দিনটি শুধু একটি উপলক্ষ নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে—“হাড়ের যত্ন নেওয়া মানে জীবনের যত্ন নেওয়া।” হাড় আমাদের শরীরের কাঠামো হিসেবে কাজ করে, তবে হাড়ের শক্তি কেবল শারীরিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
অস্টিওপোরোসিস একটি নীরব রোগ। অনেক মানুষ তাদের হাড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারেন না, যতক্ষণ না হাড় ভেঙে যায় বা স্থায়ী ব্যথা দেখা দেয়। এ রোগ মূলত হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়ার কারণে ঘটে, যার ফলে হাড় ফাঁপা, ভঙ্গুর ও সহজে ভাঙার মতো হয়ে পড়ে। এ জন্যই প্রতিরোধ এবং সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অস্টিওপোরোসিস কী?
অস্টিওপোরোসিস” শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে—“অস্টিও” মানে হাড় এবং “পোরোসিস” মানে ফাঁপা বা ছিদ্রযুক্ত। অর্থাৎ,অস্টিওপোরোসিস হলো এমন একটি রোগ যেখানে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এতে অল্প আঘাতেও হাড় ভেঙে যেতে পারে, যা রোগীর জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন এবং প্রতি পাঁচজন পুরুষের মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে ৫০ বছরের পরে মহিলাদের ঝুঁকি অনেক বেশি।
কারণ
অস্টিওপোরোসিসের মূল কারণ হলো হাড়ের গঠন ও ক্ষয়ের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত পুরনো হাড় ভেঙে নতুন হাড় তৈরি হয়। কিন্তু যখন হাড় ভাঙার গতি নতুন হাড় তৈরির চেয়ে দ্রুত হয়, তখন হাড় দুর্বল ও ফাঁপা হয়ে পড়ে। প্রধান কারণগুলো হলো:
১. বয়স বৃদ্ধি: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ক্যালসিয়াম ও কোলাজেনের পরিমাণ কমে যায়।
২. হরমোনের পরিবর্তন: মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে গেলে হাড় দুর্বল হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন কমে একই প্রভাব ফেলে।
৩. খাদ্যজনিত ঘাটতি: ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন-ডি ও ভিটামিন-কে’র অভাব।
৪. অতিরিক্ত লবণ, চা ও কফি: শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বের করে দেয়।
৫. ধূমপান ও মদ্যপান: হাড় গঠনের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৬. ব্যায়ামের অভাব: নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে হাড় দুর্বল হয়।
৭. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: দীর্ঘদিন স্টেরয়েড সেবনে হাড় ক্ষয় হয়।
৮. বংশগত কারণ: পরিবারে কারও অস্টিওপোরোসিস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
৯. অন্যান্য রোগ: থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, কিডনি বা লিভারের রোগ হাড় দুর্বল করে।এই কারণগুলো প্রাথমিকভাবে জেনে রাখা এবং সচেতন জীবনধারা অবলম্বন করা অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
> লক্ষণ
অস্টিওপোরোসিসকে বলা হয় “নিঃশব্দ রোগ”। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। রোগ তখনই শনাক্ত হয় যখন হাড় ভেঙে যায় বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা দেখা দেয়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
১. কোমর বা পিঠে ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়া ২. উচ্চতা কমে যাওয়া ৩. দেহের ভঙ্গি কুঁজো হয়ে যাওয়া ৪. সামান্য আঘাতে হাড় ভেঙে যাওয়া
৫. বারবার হাড় ব্যথা বা ক্লান্তি অনুভব ৬. কবজি, মেরুদণ্ড বা নিতম্বে হাড় ফেটে যাওয়া
এ কারণে নিয়মিত হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করা এবং শরীরের যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
> প্রকারভেদ
অস্টিওপোরোসিস প্রধানত দুই প্রকারের:
১️. প্রাথমিক অস্টিওপোরোসিস
বয়স ও হরমোন পরিবর্তনের কারণে হয়। এর দুটি উপধরন রয়েছে:
ঋতুবন্ধ-পরবর্তী: মেনোপজের পর মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
বয়সজনিত: ৭০ বছরের বেশি বয়সে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সাধারণ।
২️. মাধ্যমিক অস্টিওপোরোসিস
অন্য কোনো রোগ বা ওষুধের কারণে হয়। উদাহরণ—থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তা, কিডনি বিকলতা, দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড সেবন ইত্যাদি।
প্রকারভেদ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় ভিন্ন হতে পারে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।
> জটিলতা
অস্টিওপোরোসিস উপেক্ষা করলে বিভিন্ন গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে:
১. হাড় ভাঙা: বিশেষ করে নিতম্ব, মেরুদণ্ড ও কবজিতে।
২. স্থায়ী ব্যথা: হাড় বিকৃতির কারণে দীর্ঘস্থায়ী কোমর বা পিঠ ব্যথা।
৩. দেহ বাঁকা হয়ে যাওয়া: মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে বিকৃতি।
৪. অচলতা: হাঁটা বা চলাফেরা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৫. মানসিক প্রভাব: আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, বিষণ্ণতা ও একাকিত্ব।
৬. জীবনের মান অবনতি: দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা হয়।এই কারণে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ ও সচেতনতা অপরিহার্য।
রোগ নির্ণয়
অস্টিওপোরোসিস নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব এবং শারীরিক অবস্থার মূল্যায়ন করা হয়:
১. হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা (BMD বা DEXA):স্বাভাবিক: -১.০ বা তার বেশি।হাড় দুর্বল (Osteopenia): -১.০ থেকে -২.৫।অস্টিওপোরোসিস: -২.৫ বা তার কম।২. রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা: ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন-ডি, প্যারাথাইরয়েড হরমোন ইত্যাদি নির্ণয়। ৩. এক্স-রে বা এমআরআই: হাড় ভাঙা বা বিকৃতি শনাক্ত করা যায়। নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিসের প্রাথমিক ধাপেও প্রতিকার শুরু করা সম্ভব।
> প্রতিরোধের উপায়
অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। ছোটবেলা থেকে হাড়ের যত্ন নেওয়া হলে বয়স বাড়ার পরও হাড় শক্ত থাকে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস
১. ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার: দুধ, দই, ছোট মাছ, ডাল, তিল, বাদাম।
২. ভিটামিন-ডি: সূর্যের আলো, ডিমের কুসুম, সামুদ্রিক মাছ।
৩. ভিটামিন-কে ও ম্যাগনেসিয়াম: শাকসবজি, কলা, পালং, ব্রকলি।
৪. অতিরিক্ত লবণ, কোমল পানীয়, চা ও কফি কমানো।
> নিয়মিত শরীরচর্চা
১. ওজন বহনকারী ব্যায়াম: হাঁটা, দৌড়ানো, সিঁড়ি ওঠা-নামা।
২. যোগব্যায়াম ও হালকা স্ট্রেচিং: হাড়ের নমনীয়তা বজায় রাখে।
৩. ভারসাম্য ব্যায়াম: পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙা প্রতিরোধ করে।
পুরুষদের জন্য যত্ন
১. টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ঠিক রাখুন। ২. ধূমপান ও মদ্যপান থেকে দূরে থাকুন। ৩. প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খান ৪. শরীরচর্চা ও রোদে থাকা অভ্যাস করুন। ৫. প্রতি দুই বছর অন্তর হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করুন।
মহিলাদের জন্য বিশেষ যত্ন
১. মেনোপজের পর হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করুন।
২. ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি বেশি গ্রহণ করুন। ৩. অতিরিক্ত ডায়েট বা ওজন কমানোর ওষুধ পরিহার করুন। ৪. ধূমপান, সোডা ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন। ৫. প্রতিদিন কিছুক্ষণ সূর্যের আলোতে হাঁটুন।
শিশু ও কিশোরদের যত্ন
১. দুধ, ডিম, ছোট মাছ ও শাকসবজি প্রতিদিন দিন। ২. রোদে খেলাধুলা করুন (২০–৩০ মিনিট)। ৩. অতিরিক্ত মোবাইল ও টিভি ব্যবহার কমান। ৪. জাঙ্ক ফুড ও কোমল পানীয় পরিহার করুন। ৫. সঠিক ওজন ও ভঙ্গি বজায় রাখুন।
> দৈনন্দিন জীবনে হাড় রক্ষার টিপস
১. মেঝে পিচ্ছিল রাখবেন না। ২. ঘরে পর্যাপ্ত আলো রাখুন যেন পড়ে না যান। ৩. নরম ও আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করুন। ৪. দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হলে চশমা ব্যবহার করুন। ৫. মানসিক চাপ ও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কমান—হরমোন ভারসাম্য রক্ষার জন্য।এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো দীর্ঘমেয়াদে হাড় শক্ত রাখার ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর।
> বিশ্বে অস্টিওপোরোসিসের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত। প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন মানুষের হাড় ভাঙে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে কোমরের হাড় ভাঙলে মৃত্যুহার বেশি। বাংলাদেশেও এই রোগ দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে শহরের মহিলাদের মধ্যে। কারণগুলো হল :- * কম সূর্যালোক পাওয়া
* দুধ ও দই কম খাওয়া * অতিরিক্ত সোডা পানীয় * ব্যায়ামের অভাব * অনিয়মিত জীবনযাপন।এ কারণে সচেতনতা বৃদ্ধি, সময়মতো পরীক্ষা এবং হাড়ের যত্নের অভ্যাস গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
> হোমিও সমাধান
অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা, যেখানে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং হাড় ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়। হোমিওপ্যাথিতে এই সমস্যার জন্য এমন কিছু ওষুধ রয়েছে, যা হাড়ের ক্ষয় ধীর করতে, হাড় শক্তিশালী করতে এবং রোগীর সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করে। অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকগণ রোগীর শারীরিক অবস্থা, বয়স, হাড়ের দুর্বলতার মাত্রা এবং লক্ষণ অনুসারে ওষুধ নির্বাচন করেন।প্রাথমিকভাবে যে ওষুধগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো:ক্যালসিয়াম ফসফোরিকা,ক্যালসিয়াম কার্বোনিকা, সিলিসিয়া, কালি ফসফোরিকাম,
সিমফাইটাম অফিসিনালে,ফসফরাস, কোনিয়াম ম্যাকুলাটাম, থুজা অক্সিডেন্টালিস,আর্নিকা মন্টেনা, ক্যালসিয়াম আয়োডাটা এই ঔষধগুলো ছাড়াও রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী আরও অনেক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করা হতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগের অবস্থা জটিল হতে পারে। হোমিওপ্যাথি দীর্ঘমেয়াদীভাবে হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করতে, হাড় ক্ষয় ধীর করতে এবং শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে কার্যকর।
পরিশেষে বলতে চাই, অস্টিওপোরোসিস এমন এক নিঃশব্দ শত্রু, যা ধীরে ধীরে হাড়ের শক্তি কেড়ে নেয়। একবার হাড় ভেঙে গেলে তা আগের মতো মজবুত হয় না। তাই হাড়ের যত্ন নেওয়া মানেই জীবনের যত্ন নেওয়া। ২০ অক্টোবর — বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়,আজই হাড়ের যত্ন নিন, কালকে শক্ত জীবনে হাঁটুন। সুষম খাদ্য, সূর্যের আলো, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুস্থ জীবনযাপন—এই চারটি বিষয়ই হতে পারে হাড়ের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। হাড় শক্ত থাকলে জীবন শক্ত হয়। তাই আজ থেকেই শুরু হোক “হাড়ের যত্নের প্রতিজ্ঞা”—যেন বয়স বাড়লেও আমরা থাকি সুস্থ, সক্রিয় ও আত্মবিশ্বাসী।
এ জাতীয় আরো খবর..