ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ ;
প্রতি বছর ১৯ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় “বিশ্ব শিশু অস্থি ও সন্ধি দিবস ২০২৫।এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো— শিশুদের হাড় ও সন্ধির স্বাস্থ্য সম্পর্কে অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শরীরের গঠন টিকিয়ে রাখার জন্য অস্থি বা হাড় অপরিহার্য, আর নড়াচড়া বা চলাফেরার জন্য দরকার সুস্থ সন্ধি। একটি শিশু যখন মজবুত হাড় ও সচল সন্ধি নিয়ে বেড়ে ওঠে, তখনই সে আত্মবিশ্বাসী ও কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজন্মে পরিণত হয়। তাই এই দিবসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— “শক্তিশালী জাতি গড়তে চাইলে প্রথমেই শিশুদের অস্থি ও সন্ধি সুস্থ রাখতে হবে।”
> অস্থি ও সন্ধির ভূমিকা
অস্থি আমাদের শরীরের মূল কাঠামো তৈরি করে। এটি শরীরকে সঠিক আকার দেয়, অঙ্গগুলোকে রক্ষা করে এবং রক্ত তৈরির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, সন্ধি হলো দুটি বা একাধিক হাড়ের সংযোগস্থল, যা শরীরকে নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। হাঁটা, দৌড়ানো, বসা, ওঠা কিংবা খেলাধুলা— প্রতিটি ক্রিয়াতেই অস্থি ও সন্ধির ভূমিকা অপরিসীম।
শিশুদের অস্থি এখনো বৃদ্ধির পর্যায়ে থাকে। তাই তাদের শরীর পুষ্টির ঘাটতি, ভুল ভঙ্গি, বা সংক্রমণে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। একবার যদি হাড়ের গঠন বিকৃত হয়ে যায়, ভবিষ্যতে তা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
> শিশুদের অস্থি ও সন্ধির সমস্যার কারণ:-
১️. পুষ্টিহীনতা: ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও ভিটামিন ডি-এর অভাব হাড়কে দুর্বল করে। ফলে হাড় সহজেই বাঁকা বা ভেঙে যেতে পারে।
২️. সূর্যালোকের অভাব: সূর্যের আলো শরীরে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি উৎপাদনে সাহায্য করে। এর অভাবে হাড় নরম হয়ে রিকেটসের মতো রোগ হতে পারে।
৩️. সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস হাড়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এতে ব্যথা, জ্বর ও ফোলা দেখা দেয়।
৪️. জন্মগত ত্রুটি: কিছু শিশু জন্মের সময় থেকেই হাড় বা সন্ধির বিকৃতি নিয়ে জন্মায়, যেমন— ক্লাবফুট বা হিপ ডিসপ্লেসিয়া।
৫️. আঘাত বা দুর্ঘটনা: খেলাধুলা, পড়ে যাওয়া বা রাস্তার দুর্ঘটনায় শিশুদের হাড়ে ফাটল বা ভাঙন দেখা দিতে পারে।
৬️. অতিরিক্ত ওজন: অতিরিক্ত শরীরের ওজন হাঁটুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে ব্যথা বা সন্ধির প্রদাহ হয়।
৭️. অপুষ্টিকর জীবনযাপন: শিশুরা এখন টিভি ও মোবাইল স্ক্রিনে বেশি সময় ব্যয় করে, ফলে শারীরিক নড়াচড়া কমে যায়। এতে হাড়ের ঘনত্ব কমে ও পেশী দুর্বল হয়।
> লক্ষণ বা উপসর্গ
* হাড় বা সন্ধিতে ব্যথা ও ফোলা * সহজে হাড় ভেঙে যাওয়া * শরীরের অংশ বাঁকা হয়ে যাওয়া
* হাঁটতে বা দৌড়াতে কষ্ট হওয়া * উচ্চতা না বাড়া বা বৃদ্ধি থেমে যাওয়া * জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ * চলাফেরায় অনীহা বা ভয়
> শিশুদের সাধারণ অস্থি ও সন্ধির রোগ
১️. রিকেটস : ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিজনিত হাড় নরম হয়ে পা বা হাত বাঁকা হয়ে যায়।
২. অস্টিওমাইলাইটিস : ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে হাড়ে পুঁজ জমে ব্যথা ও জ্বর দেখা দেয়।
৩. সেপ্টিক আর্থ্রাইটিস : সন্ধিতে প্রদাহ ও পুঁজ জমে ব্যথা ও ফোলা হয়।
৪. ক্লাবফুট : জন্মগত বিকৃতি, যেখানে শিশুর পা ভেতরের দিকে ঘোরানো থাকে।
৫. হিপ ডিসপ্লেসিয়া : নিতম্বের হাড়ের অসামঞ্জস্যের কারণে শিশুর হাঁটায় সমস্যা হয়।
৬. জুভেনাইল আইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস : এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যা সন্ধিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করে।
৭. স্কোলিওসিস : মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে শরীরের গঠন বিকৃত হয়।
> জটিলতা
অস্থি ও সন্ধির সমস্যা সময়মতো চিকিৎসা না করলে এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে—
* স্থায়ী বিকৃতি ও প্রতিবন্ধকতা হাঁটা বা চলাফেরায় সমস্যা * শিশুর আত্মবিশ্বাস হ্রাস
* দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা ও ক্লান্তি * পড়াশোনা ও খেলাধুলায় পিছিয়ে পড়া * মানসিক চাপ ও সামাজিক অবহেলা
> রোগ নির্ণয়
এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা, এমআরআই বা জেনেটিক পরীক্ষা করে রোগের ধরন নির্ধারণ করা হয়।
অনেক ক্ষেত্রে শিশুর পুষ্টি, হরমোন বা রক্তের ক্যালসিয়াম-ফসফরাসের মাত্রাও পরীক্ষা করা হয়। সময়মতো সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করা গেলে ৯০% শিশুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।
> অস্থি ও সন্ধির যত্নে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
১️. পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস: শিশুর দৈনন্দিন খাদ্যে দুধ, ডিম, মাছ, বাদাম, দই, শাকসবজি ও ফল থাকতে হবে। ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও প্রোটিন হাড়ের জন্য অপরিহার্য। ফাস্টফুড, সফট ড্রিংক ও অতিরিক্ত মিষ্টিজাত খাবার হাড়ের ক্ষতি করে— তাই এগুলো সীমিত করতে হবে।
২️. সূর্যালোকে থাকা: প্রতিদিন সকালে ১৫–২০ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকলে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। এটি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে ও হাড়কে মজবুত রাখে।
৩️. নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা: দৌড়ানো, সাঁতার, সাইকেল চালানো, বা বল খেলা শিশুদের পেশী ও সন্ধিকে সক্রিয় রাখে। শারীরিক কার্যক্রম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
৪️. সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা: শিক্ষার সময় চেয়ার-টেবিলের উচ্চতা ঠিক রাখা উচিত। ভুল ভঙ্গিতে বসলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যেতে পারে।
৫️. পর্যাপ্ত ঘুম: রাতের ঘুম শিশুদের হরমোন নিঃসরণ ও হাড়ের বৃদ্ধি বাড়ায়। তাই প্রতিদিন _ ৮–১০ ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য।
৬️. পর্যাপ্ত পানি ও দুধ পান: পানি শরীরের বিষাক্ত উপাদান দূর করে এবং দুধ হাড়ে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে।
> পরিবার ও সমাজের ভূমিকা
শিশুর অস্থি ও সন্ধির যত্ন কেবল চিকিৎসকের নয়— এটি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব।
অভিভাবকের ভূমিকা: * শিশুর দৈনন্দিন ভঙ্গি, হাঁটা ও দাঁড়ানো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। * পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা ও স্ক্রিন টাইম সীমিত করা। * কোনো ব্যথা বা অস্বাভাবিকতা দেখলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: - * স্কুলে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করা। * অতিরিক্ত ভারী স্কুলব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করা।
* শিক্ষার্থীদের সঠিক বসার পদ্ধতি শেখানো।
সমাজ ও সরকারের ভূমিকা:- * স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা। * দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বিনামূল্যে পুষ্টি সহায়তা দেওয়া। * স্কুল ও ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু রাখা।
> দিবসটির তাৎপর্য
বিশ্ব শিশু অস্থি ও সন্ধি দিবস” শিশুস্বাস্থ্যের প্রতি বৈশ্বিক সচেতনতার প্রতীক।
এই দিনে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সংগঠনগুলো শিশুদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টি কর্মসূচি, পোস্টার প্রদর্শনী, সেমিনার ও আলোচনা আয়োজন করে।
শিশুরা শিখে— কিভাবে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়, কিভাবে সঠিকভাবে খেলাধুলা ও ব্যায়াম করতে হয়। এ দিবসটি চিকিৎসক ও গবেষকদেরও উৎসাহিত করে নতুন গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নিতে।
> শিশুদের জন্য বার্তা
১. প্রতিদিন সূর্যের আলোতে অন্তত ১৫ মিনিট সময় কাটাও।
২. দুধ, ডিম, মাছ, বাদাম ও শাকসবজি নিয়মিত খাও।
৩. মোবাইল ও টিভির সময় কমিয়ে বাইরে খেলাধুলা করো।
৪. পড়াশোনার সময় সোজা হয়ে বসো।
৫. কোনো ব্যথা বা ফোলা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাকে জানাও।
৬. পানি বেশি পান করো, ঘুম ঠিক রাখো, হাসিখুশি থেকো।
> শিশু হাড় ও সন্ধি সুস্থতায় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও সমাধান
শিশুদের হাড় ও সন্ধি সুস্থ রাখা তাদের শারীরিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী হাড় ও সুস্থ সন্ধি শিশুদের সঠিক বৃদ্ধি, চলাফেরা ও খেলার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। হোমিওপ্যাথি শিশুদের হাড় ও সন্ধি সুস্থ রাখতে নিরাপদ এবং কার্যকর সমাধান প্রদান করতে পারে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক রোগীর লক্ষণের উপর নির্ভর করে প্রাথমিক ভাবে যেইসব ঔষধ নির্বাচন করে থাকেন, ক্যালকারিয়া ফসফোরিকা এই ওষুধ শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি, দাঁতের বিকাশ এবং হাড়ের দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। বৃদ্ধি বিলম্বিত শিশুদের জন্য এটি বিশেষভাবে কার্যকর। এছাড়া, হাড় ভেঙে সহজে না জড়ানোর জন্যও এটি ব্যবহৃত হয়। সাইলেসিয়া): হাড় ও নখ শক্তিশালী করার জন্য এই ওষুধ খুব উপকারী। এটি হাড়ের ভঙ্গুরতা, সন্ধিতে ব্যথা এবং হাড়ের ক্ষতি দ্রুত সারাতে সাহায্য করে। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সিমফাইটাম: হাড় ভাঙা বা চোট লাগার পরে দ্রুত পুনরুদ্ধারে ব্যবহৃত হয়। হাড়ের বৃদ্ধি ও পুনর্গঠনকে ত্বরান্বিত করে। চোটের পরে ব্যবহার করলে শিশুর হাড় দ্রুত শক্ত হয় এবং ব্যথা কমে। কালি ফসফোরিকাম: বৃদ্ধি সংক্রান্ত দুর্বলতা, ক্লান্তি বা হাড় ও সন্ধি দুর্বল হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর। এটি হাড় ও পেশীর শক্তি বৃদ্ধি করে। ক্যালসিয়াম কার্বোনিকাম: হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে এবং হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। বৃদ্ধি পর্যায়ের শিশুদের জন্য এটি নিরাপদ ও কার্যকর। তাই শিশুদের হাড় সুস্থ রাখতে হোমিওপ্যাথি ওষুধের পাশাপাশি দুধ, দই, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, মাছ ও ফলমূল নিয়মিত খাওয়ানো উচিত। পর্যাপ্ত সূর্যালোক শিশুদের ভিটামিন ডি উৎপাদনে সাহায্য করে, যা হাড়ের শক্তি বাড়ায়। হাড়ে ব্যথা, সন্ধি ক্ষয়, সহজে ভাঙা হাড় বা বৃদ্ধি বিলম্ব দেখা দিলে অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। হোমিওপ্যাথি শিশুদের প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী হাড় ও সুস্থ সন্ধি গঠনে সহায়ক, যাতে তারা সুস্থ, শক্তিশালী এবং আনন্দময় জীবন উপভোগ করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, শিশুরা হলো জাতির ভবিষ্যৎ— তাদের হাড় ও সন্ধি যদি শক্ত না হয়, সেই ভবিষ্যৎও দুর্বল হবে। তাই শিশুর পুষ্টি, ব্যায়াম, বিশ্রাম ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। “বিশ্ব শিশু অস্থি ও সন্ধি দিবস” কেবল একটি দিবস নয়, বরং একটি বার্তা—আজকের যত্নই গড়বে আগামীর শক্তিশালী প্রজন্ম। পরিবার, শিক্ষক, সমাজ ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা গড়ে তুলতে পারি এক এমন বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি শিশু সুস্থ, শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠবে। তাহলেই সম্ভব হবে সত্যিকার অর্থে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ।
এ জাতীয় আরো খবর..