×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-১০-২৬
  • ৩৯ বার পঠিত
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ:

সড়ক দুর্ঘটনা আজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। প্রযুক্তির অগ্রগতি, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে প্রাণহানি, আহত মানুষ, আর স্বজন হারানোর কান্নার গল্প।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, আহত হন আরও কোটি কোটি। বাংলাদেশের অবস্থাও ভয়াবহ—প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ মারা যান সড়কে। এই সংখ্যাগুলো নিছক পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটির পেছনে আছে এক একটি ভাঙা পরিবার, হারিয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ। এই লেখায় আলোচনা করা হবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, বিদ্যমান আইন এবং বাস্তবসম্মত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে।

সড়ক দুর্ঘটনা কী

সড়ক দুর্ঘটনা বলতে বোঝায় এমন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা, যেখানে যেকোনো যানবাহন চলাচলের সময় যান্ত্রিক ত্রুটি, চালকের অবহেলা, রাস্তার সমস্যা বা আবহাওয়ার কারণে মানুষ আহত বা নিহত হয়, কিংবা সম্পদের ক্ষতি ঘটে। এটি গাড়ি, বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ—যেকোনো কিছু হতে পারে। সাধারণত এটি দুই ধরনের হয়ে থাকে—প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, যেখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং অপ্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, যেখানে আহত বা ক্ষতি হয়, কিন্তু মৃত্যু ঘটে না।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ

সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ মানুষ নিজেই। বেপরোয়া গতি, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ওভারটেকের প্রতিযোগিতা, ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো—সবই বিপদের কারণ। অদক্ষ বা প্রশিক্ষণহীন চালক, মাদকাসক্ত অবস্থায় ড্রাইভিং, আর পথচারীর অসচেতনতা যেমন ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা—এসব দুর্ঘটনা বাড়ায় বহুগুণ। এ ছাড়া সড়কের নকশাগত ত্রুটি যেমন সংকীর্ণ রাস্তা, বিপজ্জনক বাঁক, সাইনবোর্ডের অভাব, আলো স্বল্পতা বা অবৈধ পার্কিং—এসব কারণে সড়কে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। যানবাহনের ত্রুটি, যেমন পুরনো গাড়ি, ব্রেক বা লাইটের সমস্যা, অতিরিক্ত যাত্রী বা মাল বহনও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে।

প্রশাসনিক দুর্বলতা, অর্থাৎ ট্রাফিক আইনের প্রয়োগে শিথিলতা, ঘুষ, প্রভাবশালীদের রক্ষা পাওয়া, এবং বিচার না হওয়াও দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির বড় কারণ। এছাড়া বৃষ্টি, কুয়াশা বা ঝড়ের মতো পরিবেশগত কারণেও দৃশ্যমানতা কমে যায়, রাস্তায় পানি বা কাদা জমে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো সহজ হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৬,০০০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, এতে মারা যান প্রায় ৭,০০০ জন এবং আহত হন ১০,০০০-এর বেশি মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে—৬৫% দুর্ঘটনা ঘটে হাইওয়েতে, ২৫% শহরে এবং ১০% গ্রামীণ সড়কে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এখন সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তরুণদের বেপরোয়া চালনা, হেলমেট না পরা এবং প্রতিযোগিতার মানসিকতা এই বিপর্যয়কে আরও তীব্র করছে।

সামাজিক প্রভাব

সড়ক দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে পরিবারের ওপর। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হারালে পুরো পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পায়, নারীরা একা হয়ে পড়েন, শিশুরা হারায় অভিভাবক। অপরাধীরা শাস্তি না পেলে সমাজে অন্যায়ের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

সড়ক দুর্ঘটনা কেবল প্রাণহানি ঘটায় না, এটি দেশের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা দেয়। উৎপাদনশীল মানুষ হারিয়ে যায়, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যয় বেড়ে যায়, যানবাহন ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২–৩ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় প্রতিবছর।

আইনি কাঠামো ও বাস্তবতা

বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মোটরযান আইন ২০১৮, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৯ এবং ট্রাফিক বিধিমালা ১৯৮৪ (সংশোধিত)। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ খুবই দুর্বল। প্রভাবশালী অপরাধীরা প্রায়ই শাস্তি এড়িয়ে যায়, ফলে মানুষ ন্যায়বিচার পায় না, আর আইন ভয়ের বদলে উপহাসে পরিণত হয়।

প্রযুক্তির ভূমিকা

দুর্ঘটনা কমাতে আধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে চালকের গতি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করা যায়, স্মার্ট হেলমেট দুর্ঘটনা ঘটলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবস্থান পাঠাতে পারে, ড্যাশক্যাম দুর্ঘটনার কারণ ও দায় নির্ধারণে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নজরদারি ব্যবস্থায় ক্যামেরা ও সেন্সরের মাধ্যমে আইন ভঙ্গ শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।

গণমাধ্যম ও গবেষণার ভূমিকা

গণমাধ্যম কেবল দুর্ঘটনার খবর প্রচারেই সীমাবদ্ধ না থেকে, এর কারণ, প্রতিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধির দিকেও গুরুত্ব দিতে পারে। “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনের মতো উদ্যোগগুলো জনসচেতনতা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রোড সেফটি রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত গবেষণাও প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক উদাহরণ

সুইডেনের “Vision Zero” নীতি বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ। তাদের মূল লক্ষ্য—সড়কে শূন্য মৃত্যু। এজন্য তারা গতিনিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ ফুটপাত, লেন ভাগ এবং উন্নত যানবাহন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ফলে আজ সুইডেনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বিশ্বের সর্বনিম্ন। বাংলাদেশও চাইলে “Vision Zero Bangladesh” কর্মসূচি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুহার কমাতে পারে।

প্রতিকার ও করণীয়

সড়ক দুর্ঘটনা সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব না হলেও তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব—যদি সবাই নিজের দায়িত্ব বুঝে পালন করে। এজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। চালকদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স নবায়ন, স্কুল পর্যায়ে ট্রাফিক শিক্ষা এবং পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে।

আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল, স্পিড সেন্সর ও নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার করা জরুরি। হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অতিরিক্ত গতি বা লাইসেন্সবিহীন চালনায় তাৎক্ষণিক শাস্তি, প্রাণহানির ঘটনায় ফৌজদারি মামলা ও দুর্নীতি রোধে ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

নিয়মিত রাস্তা মেরামত, পুরনো গাড়ি বন্ধ, অনলাইন ফিটনেস সার্টিফিকেটে স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। প্রতিটি হাইওয়েতে দ্রুত উদ্ধার টিম, অ্যাম্বুলেন্স ও প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র থাকতে হবে। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন চালু করা জরুরি।

গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক নীতি প্রণয়ন, নাগরিকদের মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টি, শৃঙ্খলা, ধৈর্য ও মানবিকতা চর্চা—সব মিলিয়ে নিরাপদ সড়ক গড়ে তোলার পথ খুলে দিতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একক কোনো ঘটনা নয়—এটি এখন এক সামাজিক ব্যাধি। প্রতিদিনই এই বিপর্যয় আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্ষতবিক্ষত করছে। মুক্তির একমাত্র পথ হলো সচেতনতা, দায়িত্ববোধ ও আইন মেনে চলা। যদি আমরা সবাই নিজের জায়গা থেকে সততার সঙ্গে কাজ করি, তবে “নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ জীবন” আর কেবল স্লোগান থাকবে না, বাস্তবতায় রূপ নেবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat