ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব সোরিয়াসিস দিবস। এটি শুধু একটি দিবস নয়, বরং সারা বিশ্বের সোরিয়াসিসে আক্রান্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি, বোঝাপড়া ও সচেতনতার প্রতীক।
২০০৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব সোরিয়াসিস অ্যাসোসিয়েশনস (IFPA) প্রথম এ উদ্যোগ নেয়। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটি সমর্থন জানায় এবং দিনটি একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যসচেতনতা দিবসে পরিণত হয়।
এই দিবসের উদ্দেশ্য হলো— সমাজে সোরিয়াসিস সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করা, আক্রান্ত মানুষকে মানসিকভাবে শক্তি দেওয়া এবং রোগের সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।
> সোরিয়াসিস কী?
সোরিয়াসিস হলো এক দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের রোগ, যা শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধব্যবস্থার অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়। এতে ত্বকে লালচে দাগ, চুলকানি, খসখসে ভাব ও রুপালি আঁশের স্তর দেখা যায়।
এটি সংক্রামক নয়— অর্থাৎ স্পর্শ, ব্যবহার বা ঘনিষ্ঠতায় অন্য কারও শরীরে ছড়ায় না। তবু সমাজে এখনও এ রোগকে নিয়ে অযথা ভয় ও দূরত্ব তৈরি হয়।
সোরিয়াসিস সাধারণত দেখা যায়—
* কনুই, হাঁটু, মাথার ত্বক, হাত ও পায়ের নখে * কখনও পিঠ, বুক বা কোমরেও ছড়িয়ে পড়ে * মাথার ত্বকে হলে খুশকির মতো আঁশ ঝরে পড়ে।রোগের প্রকোপ কখনো কমে, কখনো আবার বেড়ে যায়— তাই এটি দীর্ঘমেয়াদে যত্নের প্রয়োজন হয়।
> কেন হয় ও কীভাবে বাড়ে
সোরিয়াসিসের নির্দিষ্ট কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে কয়েকটি বিষয় একত্রে এ রোগের জন্ম দেয়—
১. বংশগত প্রভাব: পরিবারের কারও সোরিয়াসিস থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২. ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিকতা: শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা ভুলবশত নিজের ত্বককোষকে আক্রমণ করে, ফলে কোষ দ্রুত বাড়তে থাকে।
৩. ত্বকের আঘাত বা সংক্রমণ: ছোট কাটা, পোড়া দাগ বা সংক্রমণ থেকেও রোগ শুরু হতে পারে।
৪. আবহাওয়া: শুষ্ক ও ঠান্ডা পরিবেশে রোগ বেড়ে যায়।
৫. ওষুধ ও মানসিক চাপ: কিছু ওষুধ, মানসিক উদ্বেগ, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করে। স্বাভাবিক অবস্থায় ত্বক প্রতি ২৮ দিনে একবার নবায়িত হয়, কিন্তু সোরিয়াসিস রোগীর ক্ষেত্রে এটি মাত্র ৫–৭ দিনে ঘটে। ফলে মৃত কোষ জমে গিয়ে ত্বকে পুরু স্তর তৈরি হয়।
> উপসর্গ
* ত্বক পুরু হয়ে লালচে দাগ পড়ে * দাগের ওপর রুপালি-সাদা আঁশ দেখা যায় * ত্বকে চুলকানি, জ্বালাপোড়া ও ব্যথা * মাথার ত্বক বা নখে পরিবর্তন— নখের রং নষ্ট, গর্ত বা ভঙ্গুরতা * জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলা। এই উপসর্গগুলো যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা বারবার ফিরে আসে, তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
> সোরিয়াসিস শুধু ত্বকের নয়, সারা শরীরের রোগ
গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন সোরিয়াসিসে ভোগা মানুষ শুধু ত্বকের সমস্যা নয়, আরও নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভোগেন।
জয়েন্ট প্রদাহ (Psoriatic arthritis): প্রায় ৩০ শতাংশ রোগীর জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলা দেখা দেয়।
হৃদ্রোগের ঝুঁকি: দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।
ডায়াবেটিস ও লিভার সমস্যা: সোরিয়াসিসের সঙ্গে বিপাকীয় অসামঞ্জস্যের সম্পর্ক রয়েছে।
মানসিক চাপ: চামড়ায় দাগ ও চুলকানির কারণে আত্মসম্মান কমে, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দেয়।
বিশ্ব পরিসংখ্যান
বিশ্বে প্রায় ১২ কোটি মানুষ সোরিয়াসিসে আক্রান্ত। ১৯৯০ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ মিলিয়ন, ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৩ মিলিয়ন— অর্থাৎ ৮৬% বৃদ্ধি।প্রতিবছর প্রায় ৫ মিলিয়ন নতুন রোগী যুক্ত হচ্ছে। সর্বাধিক আক্রান্ত অঞ্চল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।
এশিয়ায় গড় প্রাদুর্ভাব ৫.৭%। ১৯৯০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সোরিয়াসিসজনিত প্রতিবন্ধিতা (DALY) ৮৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
> বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে মোট জনসংখ্যার অন্তত ২–৩ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে সোরিয়াসিসে আক্রান্ত। তবে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভুল ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে অনেকেই চিকিৎসা নিতে দেরি করেন। কেউ কেউ ভেষজ বা বিকল্প চিকিৎসার পেছনে সময় নষ্ট করেন, যা জটিলতা বাড়ায়।
সামাজিকভাবে রোগীদের দূরে রাখা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বা বিবাহে সমস্যা—এসব মানসিক কষ্ট সৃষ্টি করে, যা রোগের পুনরুত্থান ঘটাতে পারে।
> সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে দৈনন্দিন যত্ন
যেহেতু এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, তাই ওষুধের পাশাপাশি জীবনধারার যত্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সহজ অভ্যাস রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে—
১. ত্বক আর্দ্র রাখুন:
ঠান্ডা আবহাওয়ায় ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। শুকনো ত্বকে প্রদাহ বাড়ে।
২. গরম পানির বদলে হালকা গরম বা ঠান্ডা পানি ব্যবহার করুন:
অতিরিক্ত গরম পানি ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট করে দেয়।
৩. সূর্যালোকের পরিমিত ব্যবহার:
সকালের নরম রোদে কিছুক্ষণ থাকা ভিটামিন D উৎপাদনে সাহায্য করে, যা ত্বকের জন্য উপকারী।
৪. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন:
মেডিটেশন, নামাজ, ধ্যান বা যোগব্যায়াম মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখে।
৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন:
এগুলো শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল করে এবং সোরিয়াসিসকে বাড়িয়ে দেয়।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন:
নিয়মিত ঘুম শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখে।
৭. চুলকানি কমানোর উপায়:
চুলকালে সরাসরি আঁচড়াবেন না; বরং ঠান্ডা সেঁক বা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
> খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা
খাবার সরাসরি সোরিয়াসিসের কারণ না হলেও কিছু খাবার রোগের তীব্রতা বাড়াতে পারে, আবার কিছু খাবার প্রদাহ কমায়।
যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত:
* চিনিযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (কোল্ড ড্রিংক, বিস্কুট, চিপস) * অতিরিক্ত লবণ বা সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার * গ্লুটেনযুক্ত শস্য (গম, বার্লি, রাই) যদি সংবেদনশীলতা থাকে
* অ্যালকোহল ও ধূমপান
> যে খাবারগুলো উপকারী:
* ওমেগা–৩ সমৃদ্ধ মাছ (সামন, সার্ডিন, টুনা) * রঙিন শাকসবজি ও ফল (গাজর, ব্রকলি, বেল পেপার, পেঁপে) * বাদাম, অলিভ অয়েল ও ডাল *পর্যাপ্ত পানি ও তাজা ফলের রস।নিয়মিত সুষম খাবার ও পরিমিত ব্যায়াম প্রদাহ কমিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
> সহানুভূতি ও সচেতনতা—সবচেয়ে বড় ওষুধ
সোরিয়াসিস রোগীরা প্রায়ই সামাজিক ভুল ধারণা ও একঘরে হওয়ার কষ্টে ভোগেন। কিন্তু মনে রাখা জরুরি— এটি ছোঁয়াচে নয়। এটি অলসতার ফল নয়। এটি মনগড়া রোগ নয়।তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনই হতে পারে সবচেয়ে বড় প্রেরণা।পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী—সবাই মিলে যদি বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি করে, রোগী আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।
> জীবনযাপনের ইতিবাচক দিকগুলো
সোরিয়াসিস মোকাবিলায় কিছু ইতিবাচক অভ্যাস দারুণ উপকারী—
* নিজের দাগ বা ত্বকের অবস্থা নিয়ে লজ্জা নয়, আত্মসম্মান ধরে রাখুন
* মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে নিয়মিত প্রার্থনা, ধ্যান বা হাঁটাচলা করুন
* পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, সামাজিকভাবে যুক্ত থাকুন
* প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দিন
* শরীরের ছোট পরিবর্তনগুলো নোট করুন, যেন চিকিৎসককে জানানো যায়
>হোমিও সমাধান
সোরিয়াসিস একটি দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ।হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি শরীরকে ভেতর থেকে সুস্থ করে তুলতে কাজ করে। এটি রোগের মূল কারণ, অর্থাৎ শরীরের অসামঞ্জস্য দূর করার মাধ্যমে আরাম দেয়। সোরিয়াসিস রোগীর জন্য অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক গন প্রাথমিকভাবে যেই সব ঔষধ লক্ষণের উপর নির্বাচন করে থাকে, আর্সেনিকাম অ্যালবাম
যাদের ত্বকে রুপালি খোসাযুক্ত শুকনো দাগ হয়, রাতে চুলকানি বাড়ে, মানসিক উদ্বেগ ও অস্থিরতা থাকে—তাদের জন্য এটি খুব কার্যকর।গ্রাফাইটিস
ত্বকে মোটা, ফাটলযুক্ত, আঠালো রস পড়া দাগ হলে এই ওষুধ উপকারী। বিশেষত যাদের ত্বক শুষ্ক ও চুলকানি যুক্ত, তাদের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। সালফার পুরনো সোরিয়াসিসে ব্যবহৃত হয়। যারা তাপে চুলকানি বেড়ে যায়, রাতে ঘুমে অস্বস্তি হয়, ত্বক লাল হয়ে খসে পড়ে—তাদের জন্য সালফার কার্যকর। ক্যালকারিয়া কার্ব, যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল, শরীরে চর্বি বেশি, ঘাম বেশি হয়—তাদের জন্য এটি উপযোগী। এটি শরীরের ভেতরকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। ন্যাট্রাম মিউর, মানসিক কষ্ট, দুঃখ বা দমন করা আবেগের পর সোরিয়াসিস দেখা দিলে এটি ভালো কাজ করে। ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়, ঠোঁট ফেটে যায়—এমন রোগীর জন্য উপকারী। মেজেরিয়াম,ত্বকে ঘন দাগ, চুলকানি, পুঁজ বা সাদা রস বের হয়—এমন সোরিয়াসিসে এটি ব্যবহার হয়। মাথার ত্বক আক্রান্ত হলে বিশেষভাবে কার্যকর।আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে।আর ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে বিশেষজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তাই অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
পরিশেষে বলতে চাই, সোরিয়াসিস কোনো অভিশাপ নয়—এটি এমন এক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা, যা সঠিক যত্নে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসার পাশাপাশি মন, খাবার ও জীবনধারা—এই তিনটি ক্ষেত্রেই সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।তাই একটু যত্ন, একটু বোঝাপড়া—এই দুই মিলে সোরিয়াসিস রোগীও সুখী, স্বাভাবিক ও আত্মবিশ্বাসী জীবন যাপন করতে পারেন।
লেখক:
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকল্যাণ গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
এ জাতীয় আরো খবর..