×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-১১-০৮
  • ১৬ বার পঠিত
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ :

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলামি শিক্ষার প্রসার, সংরক্ষণ ও সমাজ গঠনে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি, তার অন্যতম হলো কওমি মাদ্রাসা। এটি কেবল ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং এক দীর্ঘ ঐতিহ্য, আত্মত্যাগ, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসের ধারক-বাহক।

কওমি মাদ্রাসার জন্ম ও ঐতিহাসিক পটভূমি

কওমি মাদ্রাসা ব্যবস্থার সূচনা ভারতীয় উপমহাদেশে। এর প্রাথমিক রূপ মোগল আমলের শেষ দিকে দেখা গেলেও প্রকৃত বিকাশ ঘটে ১৯ শতকের মাঝামাঝি। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশরা মুসলমানদের শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর দমননীতি চালায়। ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আরবি-ফারসি ভাষা শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়, মুসলমানদের প্রশাসন ও সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।

এই সংকটকালেই ইসলামি জ্ঞান ও চেতনা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ১৮৬৬ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। “কওমি” শব্দটি এসেছে “কওম” অর্থাৎ “জনগণ” থেকে— যার মানে, জনগণের অর্থে প্রতিষ্ঠিত ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা।

দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা কাসেম নানুতুবী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি ও হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কি প্রমুখ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞান সংরক্ষণ ও মুসলমানদের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। এরপর এই শিক্ষা আন্দোলন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার সূচনা

বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গে) কওমি মাদ্রাসার যাত্রা শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে। প্রাথমিকভাবে এটি গ্রামীণ মসজিদভিত্তিক মক্তব থেকে বিকশিত হয়। তখন মুসলমানরা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল, ফলে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। জনগণের অনুদানেই গড়ে উঠতে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান।

দেশভাগের পর (১৯৪৭) পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ দশকের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নরসিংদী, ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে শত শত কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পরও এই ধারাটি দেশের ধর্মীয় চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা “দারসে নিজামী” পাঠ্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত। এটি ১৮ শতকে ভারতের লখনৌ অঞ্চলের আলেম মোল্লা নিজামুদ্দিন প্রণয়ন করেন। পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে_কুরআন তাফসির ও হাদীস অধ্যয়ন,ফিকহ (ইসলামি আইন),আরবি ভাষা ও সাহিত্য,উসুল (নীতি ও দর্শন),মন্তিক, বালাগাত, মাআন, মুনতিক প্রভৃতি বিষয়।বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো সাধারণত সাত স্তরে বিভক্ত: ইবতিদায়ী (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতা (মাধ্যমিক), সানাবিয়া উলিয়া (উচ্চমাধ্যমিক), আলিমিয়্যাহ (স্নাতক), ফাদিল/তাখাস্সুস (স্নাতকোত্তর), ইফতা (মুফতি কোর্স), এবং তাহফিজ ও তিলাওয়াত বিভাগ। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, পরিশ্রম ও আত্মনিবেদনের গুরুত্ব অসীম। শিক্ষার্থীরা নিরলস অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ইসলামি জ্ঞানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চলেছেন।

ঐতিহ্য ও বিশেষত্ব

কওমি মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য হলো স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতা। সরকারি অনুদান বা রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই জনগণের দানে পরিচালিত হয় এই প্রতিষ্ঠানগুলো। একে তাই “জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়” বলা হয়।

এখানে শিক্ষা কেবল জ্ঞানের জন্য নয়, বরং জীবন গঠনের জন্য। কওমি আলেমরা সাধারণত চাকরি বা ব্যবসার বদলে শিক্ষা, ইমামতি, সমাজসেবা ও দাওয়াতি কাজে যুক্ত থাকেন। তাদের জীবনযাপন সংযমী, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ— যা মাদ্রাসা ঐতিহ্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আলেমদের ভূমিকা

উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে কওমি আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে মাওলানা ফজলে হক খৈরাবাদি, আহমদ শাহ মাদানি, সাইয়্যিদ আহমদ ব্রেলভি প্রমুখ ছিলেন দেওবন্দীয় ধারার প্রতিনিধি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত করার পেছনেও এই চিন্তাধারার প্রভাব ছিল গভীর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালেও বহু কওমি আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, মাদ্রাসাগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বাধীনতার পরও তারা সমাজে শান্তি, ন্যায্যতা ও নৈতিকতার প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।

সমাজ ও সংস্কৃতিতে অবদান

কওমি মাদ্রাসা বাংলাদেশের সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিটি মসজিদ, মক্তব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কওমি আলেমদের সম্পৃক্ততা দেখা যায়। তারা নৈতিক অবক্ষয়, মাদক, নারী নির্যাতন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করেন।

মসজিদের ইমাম, খতিব, শিক্ষক, বক্তা— অধিকাংশই কওমি শিক্ষিত। তারা সমাজে ধর্মীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি মানবিক ও দাতব্য কার্যক্রমেও নিয়োজিত— যেমন এতিমখানা, ফ্রি ক্লিনিক, দুর্যোগ সহায়তা ও দাওয়াতি সংস্থা পরিচালনা।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি: এক ঐতিহাসিক অর্জন

দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াই চললেও ২০১৮ সালে তৎকালীন সরকার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। সর্বোচ্চ স্তর “দাওরায়ে হাদীস” ডিগ্রিকে সমতুল্য করা হয় ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রির সঙ্গে। এটি কওমি আলেম সমাজের শতবর্ষব্যাপী আন্দোলনের সাফল্য। এর ফলে কওমি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

অর্থনৈতিক ও মানবিক অবদান

কওমি মাদ্রাসা জনগণের দান-অনুদাননির্ভর প্রতিষ্ঠান। গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমজীবীরা মাসিক অল্প অল্প অর্থ দান করে শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন— এটি এক অনন্য জনমুখী শিক্ষা আন্দোলন।

হাজারো কওমি আলেম বিনা পারিশ্রমিকে ইমামতি করছেন, দরিদ্র শিশুদের পড়াচ্ছেন, সমাজে সেবা দিচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নীরবে ভূমিকা রাখছে— এটি কওমি ব্যবস্থার মানবিক মুখ।

জ্ঞানচর্চা, চিন্তাধারা ও সংস্কার

কওমি শিক্ষার লক্ষ্য কেবল ধর্মীয় জ্ঞান নয়; বরং নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক মানুষ তৈরি করা। এখানে কুরআন ও হাদীসের গভীর ব্যাখ্যা, ইসলামী দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের গবেষণা পরিচালিত হয়।

তবে সমালোচনাও রয়েছে— আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব, নারীদের সীমিত অংশগ্রহণ, এবং কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কওমি মাদ্রাসা বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও কম্পিউটার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। কওমি ও আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণই হতে পারে ভবিষ্যতের পথ।

কওমি শিক্ষা: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দিগন্ত

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ২০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের নৈতিক মেরুদণ্ড গড়ে তুলছে, ইসলামি চেতনার ধারক প্রজন্ম তৈরি করছে।

যদি এই ধারায় আধুনিক গবেষণা, ভাষা ও প্রযুক্তি শিক্ষা যুক্ত হয়, তবে কওমি মাদ্রাসা হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের জ্ঞান ও নৈতিকতার কেন্দ্র।

পরিশেষে বলা যায়, কওমি মাদ্রাসা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়— এটি এক ঐতিহ্য, এক আন্দোলন, এক বিশ্বাস। এখান থেকে যে মানুষ গড়ে ওঠে, তারা পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক থেকেও আদর্শবান। বাংলাদেশের নৈতিক মান, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনা সংরক্ষণে কওমি মাদ্রাসার অবদান অনন্য।

ভবিষ্যতে যদি গবেষণা, সংস্কার ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটে, তবে এই শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে এমন এক মডেল— যা ঈমান, জ্ঞান ও মানবিকতার সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করবে।

লেখক: কওমি শিক্ষাব্যবস্থার অনুরাগী ও ইসলামিক স্টাডিজ গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat