২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান সমর্থকদের কংগ্রেস ক্যাপিটল হিল (কংগ্রেস ভবন) হামলায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জড়িত বলে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
বাইডেনের জয়কে আনুষ্ঠানিক করার প্রক্রিয়ায় ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বসে। সেদিন ট্রাম্প সমর্থকেরা কংগ্রেস ক্যাপিটল হিলে হামলা চালান।
এদিকে, বরাবরের মতো রিপাবলিকান ওই রাজনীতিবিদ ট্রাম্প ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে অস্বীকার করে আসছেন এবং মামলাটিকে "হাস্যকর" বলে বর্ণনা করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মামলা ছাড়াও অন্য আরও দুইটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ফাইল অব্যবস্থাপনা করা এবং একজন পর্ন তারকাকে অবৈধ অর্থ প্রদানের নথি ঢাকতে ব্যবসায়িক রেকর্ড জাল করার মতো অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এখন প্রশ্ন হলো এসব মামলায় ট্রাম্প কি জেলে যাবেন? নাকি পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মার্কিন আইনে কোনো বাধা আছে কিনা?
কী কী অভিযোগ রয়েছে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে?
ট্রাম্প ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ করার অপরাধে অভিযুক্ত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের পক্ষে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশেষ আইনজীবী জ্যাক স্মিথ। স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে ৪৫ পাতার ওই অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মোট চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই অভিযোগে বলা হয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করার ষড়যন্ত্র, অফিসিয়াল কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র, অফিসিয়াল কার্যক্রমে বাধা দেওয়া এবং নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ট্রাম্প।
প্রথম অভিযোগটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনা, ভোট সংগ্রহের প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের ফলাফলেকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মিথ্যা অভিযোগ। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অভিযোগটি ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার মাধ্যমে মার্কিন কংগ্রেসে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের ফলাফলের আনুষ্ঠানিকতা কে বাধা দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত। চতুর্থ অভিযোগটি হল নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার এবং তাদের ভোট গণনা করার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ।
নির্বাচনের দিন ৩ নভেম্বর থেকে ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউস ত্যাগ করা পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে ট্রাম্প এসব পদক্ষেপ নেন বলে অভিযোগ করা হয়।
অভিযোগপত্রে উল্লেখিত একটি মিথ্যা দাবি হলো- ট্রাম্প জয়লাভ করেছেন এবং নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছে মার্কিন বিচার বিভাগ এবং মাইক পেন্সের কাছে জো বাইডেনের ইলেক্টোরাল ভোট প্রত্যাখানের ক্ষমতা রয়েছে, এমন তথ্যও ছড়িয়েছেন ট্রাম্প।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২১টি মিথ্যা নথিভুক্ত হলেও ট্রাম্পের আরও ভুয়া দাবি তালিকার বাইরে থেকে গেছে। নির্বাচনে ফল পাল্টে দেওয়ার মামলায় আজ ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে হাজির হবেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
আগের অভিযোগের তুলনায় অভিযোগ কতটা গুরুতর?
গত চার মাসে এটা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি তার বিরুদ্ধে আনা সবচেয়ে শক্তিশালী মামলা নাও হতে পারে। তিনি অন্য কোনও মামলায় গভীর আইনি বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন।
বিবিসির নর্থ আমেরিকা সম্পাদক সারাহ স্মিথ বলেছেন, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় অভিযোগগুলো সবচেয়ে গুরুতর এবং পরিণতিমূলক।
তিনি বলেন, দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে ট্রাম্পই প্রথমবার এমন কিছুর জন্য অভিযুক্ত হচ্ছেন। তবে এই অভিযোগের বাস্তব-বিশ্বের প্রভাবও রয়েছে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে এরকমটা দেখিনি।
এদিকে, সাবেক ফেডারেল প্রসিকিউটর রেনাতো মারিওটি বিবিসি'র টুডে প্রোগ্রামকে বলেন, একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে তার অফিসের জন্য এবং অনন্য আচরণের জন্য অভিযুক্ত করা মার্কিন ইতিহাসে প্রথম। অন্য কথায় "পদে থাকার চেষ্টা করা এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ স্থানান্তর রোধ করার অভিযোগ করা হলো।
এরপরে কি হবে?
ট্রাম্পকে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসির আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে। তিনি সরাসরি হাজির হবেন নাকি অন্যভাবে হাজিরা দিবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তদন্তের নেতৃত্বদানকারী আইনজীবী জ্যাক স্মিথ, দ্রুত বিচারের আওতায় এ মামলার নিষ্পত্তি চেয়েছেন তবে বিভিন্ন কারণে এটি ঘটবে কি না তা নিশ্চিত নয়।
মার্কিন নির্বাচনী ফল পাল্টে দেওয়ার ৪৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ২১টি মিথ্যা দাবি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ক্যাপিটল হিলে হামলার ক্ষেত্রে এসব তথ্য ইন্ধন জুগিয়েছে বলে জানান বিশেষ আইনজীবী জ্যাক স্মিথ।
তবে মারিওটি বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান, মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় বিচার দীর্ঘায়িত করার জন্য অনেক উপায় রয়েছে। তাই এখনো ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্প জেলে যাবেন নাকি প্রেসিডেন্টে নির্বাচন করবেন?
ট্রাম্প ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। কিন্তু তাঁর বয়স এখন ৭৭ বছর। এর মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে। এবং সেই মামলায় তিনি ইতিমধ্যে অভিযুক্ত হয়েছেন। দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন তিনি। এদিকে, মামলার তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত বিচারক ওবামা প্রশাসেনর সময় নিযুক্ত।
নথি গোপনের মামলায় ট্রাম্প ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সম্মুখীন হতে পারেন। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হলো মার্কিন আইনে, কোনও ব্যক্তি যদি ফৌজদারি অভিযোগের সম্মুখীন হয়, বা এমনকি যদি কারাবরণ করেও থাকেন তবে কোনও ব্যক্তির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা নেই। অবশ্য এর মানে এই নয় যে ভোটাররা এমন প্রার্থীকে সমর্থন করতে চাইবে।
অন্তত দু'জন ব্যক্তি এর আগে দোষী সাব্যস্ত হয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। যাদের মধ্যে ১৯২০ সালে সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী ইউজিন ডেবস, যিনি ১৯১৮ সালের যুদ্ধ বিরোধী বক্তৃতায় দোষী সাব্যস্ত হন। ষড়যন্ত্রকারী লিন্ডন লারুচে, জালিয়াতির জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে উভয়েই নির্বাচনে পরাজিত হন।
নির্বাচনে জিতলে ট্রাম্প কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন?
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্প নিজেকে ক্ষমা করার চেষ্টা করতে পারেন যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং তারপর নির্বাচনে জয়ী হন। তবে এটি মার্কিন আইনে পরীক্ষিত নয়, অর্থাৎ এবিষয়ে তখন সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।
তিনি মামলাটি খারিজ করার চেষ্টা করতে পারেন যদি তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রিপাবলিকান মনোনয়নের জন্য একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাবেক আরকানসাসের গভর্নর আসা হাচিনসন এনবিসি নেটওয়ার্ককে বলেন, উভয় পরিস্থিতিই সম্ভব। তবে আত্ম-ক্ষমার বিষয়টি সংবিধানের নেই। তিনি যোগ করেন, এই ধরনের পদক্ষেপ অনুপযুক্ত এবং অপ্রীতিকর হবে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন । এ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পরাজয় মানতে অস্বীকৃতি জানান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বাইডেনের জয়কে আনুষ্ঠানিক করার প্রক্রিয়ায় ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন বসে। সেদিন সমর্থকেরা কংগ্রেস ক্যাপিটল হিলে (কংগ্রেস ভবন) হামলা চালান।
এ হামলার ঘটনায় এক হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প।
এ জাতীয় আরো খবর..