×
সদ্য প্রাপ্ত:
  • প্রকাশিত : ২০২৫-০২-০৮
  • ৪৭ বার পঠিত

গাজা বিশ্বের অন্যতম সংকটাপন্ন অঞ্চলগুলোর একটি, যেখানে প্রতিনিয়ত সংঘাত ও অস্থিরতার মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ অসহায় মুসলমানকে। তাদের জীবনধারণের প্রতিটি দিকেই অভাব ও নির্যাতন বিরাজমান। এই প্রবন্ধে গাজার অসহায় মুসলমানদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা এবং তা কিভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে তা বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

> গাজার ইতিহাস ও বর্তমান সংকট

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা মধ্যপ্রাচ্যের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল, যেখানে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের দখল এবং অবরোধের মধ্যে রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হতে থাকে। গাজা সেই সংকটের একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরোধের আওতায় আছে। এই অবরোধের ফলে গাজার মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিকভাবে চরম সংকটে পড়ে। জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই, বিদ্যুৎ এবং পানির সরবরাহ সীমিত, চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল, এবং শিক্ষার সুযোগ কম। উপরন্তু, নিয়মিত ইসরায়েলি হামলার ফলে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে এবং অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়।

> গাজার বর্তমান পরিস্থিতি

১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত গাজায়। সহিংসতার অবসানের জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এই লড়াইয়ে?

গাজা ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল, যা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি অবরোধের শিকার। এই অবরোধের ফলে গাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং সাধারণ জনগণ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবও সেখানে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি, হাসপাতালে চিকিৎসার ঘাটতি, এবং কর্মসংস্থানের অভাব মানুষকে দারিদ্র্যের অতলে ঠেলে দিচ্ছে।

গাজার এই মানবিক সংকটের মূলে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন।

> এক নজরে গাজায় ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসযজ্ঞ সংখ্যায় দেখে নেওয়া যাক- 

* গাজায় নিহত মোট ফিলিস্তিনি নাগরিক: ৪৬ হাজার ৭০৭ জন। 

* গাজায় নিহত শিশু : ১৩ হাজার ৩১৯টি। 

* গাজায় ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন বলে ধারণা করার হচ্ছে এমন মানুষ : প্রায় ১১ হাজার। 

* গাজায় আহত ফিলিস্তিনি : ১ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন। 

* গাজায় বাস্তুচ্যুত মানুষ: প্রায় ১৯ লাখ, যা  উপত্যকাটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। 

* যুদ্ধের সময় গাজার স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে হামলা : ৬৫৪টি। 

* নিহত স্বাস্থ্যকর্মী : ১ হাজার ৬০ জন। 

* ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হওয়া স্কুল : ৫৩৪টি, যা মোট স্কুলের প্রায় ৯৫ শতাংশ। 

* আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া শিশু : ৬ লাখ ৬০ হাজার। এতে সব বয়সী স্কুলগামী শিশুদের ধরা হয়েছে। 

* ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হওয়া বাড়ি-ঘর : ৪ লাখ ৩৬ হাজার, যা উপত্যকাটির মোট বাড়ি-ঘরের প্রায় ৯২ শতাংশ। 

* ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর  ইসরায়েল মোট নিহত : প্রায় ১ হাজার ২০০ জন। 

* জিম্মি করে গাজায় নিয়ে আসা হয় : ২৫১ জনকে। 

* গাজায় এখনো থাকা জিম্মি : ১০১ জন। এর মধ্যে ৩৭ জন মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। 

এখানে ফিলিস্তিনি হতাহতের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তা গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের
> পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা

 ৯১ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে আছে।পুনর্বাসন শুধু গাজার বাসিন্দাদের জন্য একটি মানবিক সহায়তার বিষয় নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। পুনর্বাসনের মাধ্যমে শুধু যে গাজার মানুষগুলোর জীবনমান উন্নত হবে তা নয়, বরং এটি পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

১. আশ্রয় পুনর্গঠন

যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের ফলে গাজার হাজার হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। স্থায়ী বসতি গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে।

২. স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ

গাজার স্বাস্থ্যখাত চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম, হাসপাতাল, এবং চিকিৎসক না থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা জরুরি।

৩. শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি

গাজার শিশু-কিশোরদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু তাদের ভবিষ্যৎ নয়, পুরো সমাজের জন্যই নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

৪. খাদ্য ও পানীয় জল সরবরাহ

গাজায় খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট একটি বড় সমস্যা। মানসম্পন্ন খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

৫. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি

গাজার মানুষের অধিকাংশই বেকার। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে দারিদ্র্য কমবে এবং তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারবে।

> কিভাবে পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতে পারে?

১. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা

গাজার পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ, মানবিক সহায়তা প্রদান, এবং রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

২. দাতব্য সংস্থার কার্যক্রম

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা গাজার পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, এবং পুনর্বাসনের জন্য তারা স্থানীয়ভাবে কাজ করতে পারে।

৩. ইসলামী বিশ্বের উদ্যোগ

মুসলিম দেশগুলোকে গাজার মানুষের জন্য আর্থিক ও মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামী সংহতি ও একতার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।

৪. উন্নত অবকাঠামো নির্মাণ

গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুধু পুনর্বাসনের একটি অংশ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. মিডিয়ার ভূমিকা

গাজার মানুষের কষ্ট এবং তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে এই সংকট সমাধানে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব।

> গাজার পুনর্বাসনে আমাদের দায়িত্ব

গাজার মানুষের প্রতি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। মানবিক সহায়তা, দান, এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।

১. দান এবং সহায়তা

আমরা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে অর্থ, খাদ্য, পোশাক, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দান করে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি।

২. দোয়া এবং সমর্থন

গাজার মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা এবং তাদের সমর্থনে কথা বলা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধি

গাজার সংকট সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করা আমাদের দায়িত্ব।

পরিশেষে বলতে চাই, গাজার অসহায় মুসলমানদের পুনর্বাসন একটি মানবিক, নৈতিক, এবং ধর্মীয় দায়িত্ব। এই কাজ শুধু তাদের জীবনে পরিবর্তন আনবে না, বরং পুরো বিশ্বে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। তাই, আমাদের সবার উচিত একযোগে কাজ করা এবং তাদের জীবনে একটি নতুন সূচনা এনে দেওয়া।আর জাতিসংঘের ধারণা, প্রায় ১৯ লাখ মানুষের জরুরি আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীতে প্রয়োজন।যুদ্ধবিরতি হয়তো ত্রাণ পৌঁছানো সহজ করবে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, গাজা কীভাবে আবার গড়ে তোলা হবে। ১৫ মাসের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর গাজা পুনর্গঠনে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।

লেখক, সংগঠক,কলাম লেখক ও গবেষক 
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat