মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শ্রমবাজার ইরাকে কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম স্থবির ছিল দীর্ঘদিন। অচলাবস্থা কাটাতে নতুন করে বাংলাদেশ-ইরাক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সে অনুযায়ী দেশটিতে শুরু হয়েছে কর্মী যাওয়া। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি কর্মী ইরাকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জানা যায়, চলতি বছরের ১৪-১৫ সেপ্টেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ-ইরাকের মধ্যে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হয়। বৈঠকে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
৭০ জন শ্রমিক এরই মধ্যে ইরাকে গেছেন, বাকিরা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যাবেন। এসব কর্মীর ভিসা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ইরাক থেকেই আসছে। আমরা যাওয়ার প্রসেসটা শুধু করছি। খরচ হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা।- আল-রোতান প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. খোরশেদ আলম
বৈঠক সূত্র জানায়, ইরাক সরকার বাংলাদেশিদের নিয়োগের বিষয়ে ভূমিকা গ্রহণ, নিরাপদ, নিয়মিত ও সুশৃঙ্খল শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করতে ইরাকি নিয়োগকর্তার চাহিদাপত্র বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়নের পর কর্মী নিয়োগ করবে। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে ইরাকে গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীরা সে দেশে যাওয়ার আগে কর্মসংস্থান চুক্তি সই করবেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সাধারণ কর্মীদের মাসিক বেতন তিনশ ও গাড়িচালকদের বেতন চারশ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য মেডিকেল, আবাসন ও পরিবহন ফ্রি থাকবে। চুক্তির মেয়াদ দুই বছর। বছরে ১৫ দিনের ছুটির সুযোগ দেওয়া হবে। প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে, সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ইরাকে পাঠানোর জন্য প্রত্যেক কর্মীর অভিবাসন ব্যয় ৬৫ হাজার ২৯০ টাকা।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল স্বাক্ষরিত এ অনুমোদনপত্রে বলা হয়েছে, ইরাকে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩-এর ১৯ (৩) ধারা অনুযায়ী কঠোরভাবে বিএমইটির চলমান ডাটাবেজ থেকে কর্মী নির্বাচন করতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এক্ষেত্রে অবশ্যই বিএমইটি জারি করা প্রসেস ফলো চার্ট অনুসরণ করতে হবে।
বহির্গমন ছাড়পত্রের আগে প্রত্যেক নির্বাচিত কর্মীর সঙ্গে নিয়োগ চুক্তি সই করা বাধ্যতামূলক। চুক্তির বিষয়টি রিক্রুটিং এজেন্সিকেই নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিপত্রের বাংলা অনুবাদ করা কপি বিএমইটি সত্যায়ন করে প্রত্যেক কর্মীকে দিতে হবে।
অনুমোদনপত্রের এই শর্তে আরও বলা হয়েছে, চুক্তিপত্রের কোনো শর্ত লঙ্ঘন করা যাবে না। অনুমোদিত কর্মীরা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে চাকরির নিশ্চয়তা পাবেন এবং প্রস্তাবিত বেতন-ভাতা, আবাসন ও অন্য সুবিধা ভোগ করবেন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মীর থাকা-খাওয়ার খরচ ও প্রত্যাবর্তন ব্যয়সহ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এজন্য ৩শ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা দাখিল করতে হবে।
ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত বুর্জ আল খালিজি কোম্পানিতে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর অনুমোদন পেয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সি আল-রোতান প্রাইভেট লিমিটেড। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৮শ ৭৫ জন শ্রমিক পাঠাবে। এর মধ্যে ১৮শ ৪৫ জন সাধারণ কর্মী ও ৩০ জন গাড়িচালক নিয়োগ দেওয়া হবে।
এরই মধ্যে এই সমোঝতা স্মারক অনুযায়ী ইরাকে কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে আল-রোতান প্রাইভেট লিমিটেড। এজেন্সিটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘৭০ জন শ্রমিক এরই মধ্যে ইরাকে গেছেন, বাকিরা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যাবেন। এসব কর্মীর ভিসা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ইরাক থেকেই আসছে। আমরা যাওয়ার প্রসেসটা শুধু করছি। খরচ হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যে টাকার কথা উল্লেখ করেছে সেটা তো অভিবাসন ফি। আমাদের মাধ্যমে কর্মীরা যাচ্ছেন প্যাকেজের মাধ্যমে। এতে প্লেন ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক ফি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে এ শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ ছিল। অনেক চেষ্টার পর এই কর্মীরা যাবেন। বিশেষ করে ইরাকে যারা পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে আছেন, তারাই ভিসা দিতে সহায়তা করছেন। শুধু এই ১ হাজার ৮৭৫ জন না, যেহেতু বাজার সচল হয়েছে, সামনে আরও এক হাজার কর্মী যেতে পারেন।’
মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটিতে বিগত এক দশকে কর্মী পাঠানোয় গতি থাকলেও সবশেষ পাঁচ বছরে অনেকটা স্থবির ছিল। বিএমইটি তথ্য অনুযায়ী, চলতি (২০২৫) বছরের প্রথম ছয় মাসে ইরাকে গেছেন ২০৪ জন। ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ বছরে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২২৯ জন। যদিও এর আগে ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ইরাকে যান ৫১ হাজার ৩৭২ জন কর্মী।
বাংলাদেশ ওভারসিজ অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেজ লিমিটেডের (বোয়েসেল) সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইটি) মো. নূরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইরাকে মোটামুটি ভালো বেতন পাওয়া যায়। দেশটিতে চলতি বছর বোয়েসেলের মাধ্যমে ৮০ জন কর্মী গেছে। এদের সবাই দক্ষ। বোয়েসেলের মাধ্যমে গেলে দক্ষ কর্মী ৫৬ হাজার ৩৫০ টাকা, স্বল্প দক্ষ কর্মী ৪৪ হাজার ৮৫০ টাকা খরচ।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, যদি কর্মী ঠিকভাবে পাঠানো যায়, তাহলে এই শ্রমবাজারটা স্বাভাবিক হবে। এক্ষেত্রে কর্মীদের নিরাপত্তা ও বেতন-ভাতা নিশ্চিত জরুরি।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজে বলেন, ‘সমোঝতা স্মারকের চেয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বেশি জরুরি। এতে জবাবদিহিতা থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যেন সাইন করেই দায়িত্ব শেষ না করে। তারা যে শর্ত দিয়েছে, সেগুলো যেন এজেন্সি ও ইরাক কর্তৃপক্ষ মানে, এটা তদারকি করা। এজেন্সির ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজার দীর্ঘ করতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ জরুরি। ইরাক সরকারকেও দায়িত্ব দিতে হবে। যেহেতু ইরাক মাঝে মধ্যে অস্থিতিশীল হয়, কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সুস্পষ্ট থাকা দরকার। ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে, কর্মীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় ইরাকে অস্থিতিশীলতা কিংবা যুদ্ধবিগ্রহে নজরে রাখতে হবে। দূতাবাসকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমত, ইরাক বা লিবিয়ার মতো অস্থিতিশীল বাজারে কর্মী পাঠানোর আগে আমি মনে করি তাদের নিরাপত্তা ও বেতন নিশ্চিত জরুরি। কারণ, এই দেশগুলোতে যুদ্ধ কিংবা ও অস্থিতিশীলতার শঙ্কা থাকে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে কর্মী পাঠাতে প্রায় সব দেশেই অভিবাসন খরচ অনেক বেশি। এসব টাকা তুলতে কর্মীদের দুই বছরের বেশি সময় লেগে যায়। কারও কারও আরও বেশি সময় লাগে। তাই সরকার নির্ধারিত যে খরচ আছে, এ খরচটা এজেন্সিগুলোর মেনে চলা উচিত। আর সরকারকেও সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
পাশাপাশি সরকার নির্ধারিত এ খরচ বাস্তবসম্মত কি না সেটাও দেখা উচিত বলে মনে করেন এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ।