মোঃ অলি উদ্দিন মিলন, বিশেষ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক 'আলাউদ্দিনের চেরাগ'—যা কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি শ্রেণির জন্য সীমাহীন ঐশ্বর্য এনে দেয়, কিন্তু সাধারণ জনগণের ভাগ্যে জোটে কেবলই বঞ্চনা। বারবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও রাজনীতির মূল সুর বদলায় না; বরং টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবির বাজি, এবং হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।
অর্থ পাচারের স্বর্গরাজ্য: বিত্তবানদের বিদেশে বিলাসী জীবন
জনগণের ট্যাক্সের টাকা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবৈধ উপায়ে লুটপাট করে বিদেশে পাচার একটি ভয়াবহ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের (২৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি) অর্থ পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত অর্থ মূলত রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে বিদেশে বিলাসবহুল সম্পত্তি ক্রয়, সন্তানদের ব্যয়বহুল শিক্ষা ও স্থায়ী নিবাস গড়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
টিআইবি (টিআইবি) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশ কার্যত অর্থ পাচারের 'স্বর্গরাজ্যে' পরিণত হয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের চাপে জর্জরিত, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সন্তানরা বিদেশে কোটি টাকার শিক্ষা ও জীবনযাপন করছে—এই বৈষম্য এখন আর গোপন নেই।
ক্ষমতার উৎস জনগণ, কিন্তু ভোগ করে কে?
'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস'—এই স্লোগানটি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি প্রতিষ্ঠিত ভিত্তি হলেও, বাস্তবে ক্ষমতা যখন কোনো দল বা গোষ্ঠীর হাতে যায়, তখন তা জনগণের সেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ক্ষমতার এই অপব্যবহারের মূল ক্ষেত্রগুলো হলো:
টেন্ডার ও ঘুষের সংস্কৃতি: অবকাঠামো নির্মাণ, সরকারি ক্রয়, এবং উন্নয়ন প্রকল্পে ভয়াবহ দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর লাখ লাখ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে হাতবদল হয়। রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের যোগসাজশে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়, যার ফলে সাধারণ জনগণ নিম্নমানের পরিষেবা ও ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পের ফল ভোগ করে।
চাঁদাবাজি ও আধিপত্য: স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামো মজবুত করা হয়। সাধারণ ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও নিরীহ মানুষ প্রতিনিয়ত এই চাঁদাবাজির শিকার হন।
রাজনৈতিক সংঘাতে সাধারণের রক্ত: গরিবেরাই কেবল জিম্মি
রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংঘাতের সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলো এর শিকার হওয়া সাধারণ মানুষ। প্রায়শই ক্ষমতার লড়াইয়ে দুই বা ততোধিক রাজনৈতিক দলের অন্তঃকোন্দল কিংবা সংঘর্ষের বলি হয় সাধারণ জনগণ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতি বছর অসংখ্য নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে, যাদের অনেকেরই কোনো সক্রিয় রাজনৈতিক পরিচয় থাকে না।
এ ক্ষেত্রে একটি কটু সত্য হলো: রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চপদস্থ নেতাদের সন্তানদের সহিংসতায় মারা যাওয়ার খবর প্রায় বিরল। সংঘাতের শিকার হয় মূলত নিম্নবিত্ত, গরিব পরিবারের সন্তানরা, যারা হয়তো অর্থের বিনিময়ে বা রাজনৈতিক আদর্শের মোহে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, রাজনীতিতে ঝুঁকি নেওয়ার দায় ও ক্ষতির ভার কেবল নিরীহ মানুষ এবং গরিব পরিবারগুলোর ওপরই পড়ে—নেতৃত্বের জন্য নয়।
উপসংহার: আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন
বর্তমান প্রেক্ষাপটে, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো একটি অর্থনীতিবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। অন্তর্বর্তী সরকার এখন অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলছে। জনগণের পক্ষ থেকে এই বার্তা স্পষ্ট: রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে সকলের উচিত ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে জনগণের মৌলিক চাহিদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এক সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা।