ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকৃতির প্রতিটি ঋতুই আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর পরিপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ। শীত ঋতু মানব জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শরীর ও মন উভয়ের জন্য শীতের মৌসুম একটি নতুন শক্তি, নতুন রুটিন এবং আল্লাহর কাছে নিকট হওয়ার সুযোগ হিসেবে কাজ করে। কোরআন ও হাদিসে আমাদের জীবনযাপনে ঋতুর প্রভাব এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমল করার গুরুত্ব উল্লেখ রয়েছে। শীতের আগমন শুধু আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়, বরং এটি আমাদের আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতা বৃদ্ধিরও একটি সুযোগ।
১. আল্লাহর সৃষ্টিতে শীতের নিখুঁত পরিকল্পনা
কোরআনে আল্লাহ বলেন:“তিনি আকাশ থেকে পানি নামান; এরপর আমরা তা দিয়ে মৃত ভূমিকে জীবন দিই। এভাবেই মানুষের জন্য সবকিছু পরিষ্কার ও সুপরিকল্পিত করেছেন।(সুরা জুমার-১১) শীতের আগমন প্রকৃতিকে বিশ্রাম এবং পুনর্জীবনের সময় প্রদান করে। শীতকালীন বরফ, ঠাণ্ডা বাতাস এবং কম তাপমাত্রা সবই পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ইসলামে প্রকৃতির প্রতি সচেতন থাকা এবং সৃজনশীল ব্যবহারের আহ্বান রয়েছে। শরৎকাল শেষ হওয়ার পর শীতের আগমন মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা, পরিশীলন এবং স্বাস্থ্য সচেতনার আহ্বান নিয়ে আসে।
২. শীতকালীন স্বাস্থ্য ও পবিত্রতা
শরীর সুস্থ রাখতে শীতকালীন যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে বলা হয়েছে: “সাধু ব্যক্তি সেই, যিনি নিজের শরীরের যত্ন নেয়।(সুনান ইবনে মাজাহ- ৩৪৭৮) শীতের আগমনীতে গরম পোশাক পরা, শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখা এবং সঠিক খাদ্য গ্রহণ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সুস্থ থাকার আমল হিসেবে গণ্য। গরম খাবার ও গরম পানীয় শরীরকে শীতের ব্যথা ও অসুখ থেকে রক্ষা করে।
৩. শীতকালীন ইবাদতের গুরুত্ব
শীতের আগমন আমাদের ইবাদতের সময়সূচী এবং নিয়মে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনে। দীর্ঘ রাত ও ঠাণ্ডা সকালে নামাজের সময় আমরা ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরীক্ষা দিই। হাদিসে এসেছে: “যে ব্যক্তি কষ্টের মধ্যে নামাজ আদায় করে, আল্লাহ তার জন্য পুরস্কার দ্বিগুণ দেন।”(সহীহ বুখারি- ৬৩০) শীতের সময়ের তাপমাত্রা অনেককে আলসেমি বা ধীরগতি তৈরি করতে পারে। তবে ইসলামে ধৈর্য্যশীলতা ও সঠিক নিয়মের মাধ্যমে নামাজ, দোয়া ও অন্যান্য ইবাদত বজায় রাখাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
৪. সমাজসেবা ও দান
শীতকালীন আগমনী দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য বিশেষ সুযোগ। নবী করিম (সা.) বলেছেন:-যে ব্যক্তি শীতকালে কারো ত্রাণ দেয়, আল্লাহ তাকে জান্নাতের তাপ থেকে রক্ষা করবেন।(সুনান তিরমিজি- ১৬৯১)
শীতের সময় দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য কফিন, কম্বল, উষ্ণ খাবার বা দান দেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি কেবল দুনিয়ার কল্যাণ নয়, বরং আখেরাতের জন্যও সাফল্যের একটি মাধ্যম।
৫. শীতকালীন দৈনন্দিন আমল
শীতের আগমনীকে আমরা দৈনন্দিন জীবনে নিম্নলিখিত আমলের মাধ্যমে সক্রিয় করতে পারি:
১. সকালের দু’আ এবং কোরআন পাঠ: ঠাণ্ডা সকালে সূর্যোদয়ের সময় কোরআন পাঠ ও দোয়া আমাদের মন ও শরীরকে শক্তি দেয়।
২. উষ্ণ পোশাক এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য: শরীরকে সুরক্ষিত রাখা ইসলামে সুস্থ থাকার অংশ।
৩. দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য: শীতকালে কম্বল, উষ্ণ খাবার ও দান বিতরণ।
৪. নামাজে ধৈর্য্য এবং শৃঙ্খলা: শীতের কারণে নামাজে দেরি না করা ও সঠিক সময়ে আদায় করা।
৫. পরিবেশ সচেতনতা: আল্লাহর সৃষ্টি রক্ষার জন্য শীতকালে জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদ সংরক্ষণ।
৬. আত্মশুদ্ধি ও ধৈর্য্য বৃদ্ধি
শীত আমাদের শিক্ষা দেয় ধৈর্য্য এবং স্থিরতা। কোরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়: “নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের জন্য আল্লাহ বড় পুরস্কার সংরক্ষণ করেছেন।(সুরা জুমার-১১) শীতের দীর্ঘ রাত, কুয়াশা ও ঠাণ্ডা পরিবেশ আমাদের আত্মশুদ্ধি ও মননচিন্তায় গভীরতার সুযোগ দেয়। বেশি সময় ঘরে থাকা এবং ধ্যান-ধ্যান ও কোরআন পাঠ আমাদের রূহানী শক্তি বৃদ্ধি করে।
পরিশেষে বলতে চাই,শীতকাল শুধু আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবন, ইবাদত এবং সমাজসেবায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সুযোগ নিয়ে আসে। কোরআন ও হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃতি ও ঋতু আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টির অংশ। শীতের আগমনকে আমরা সুস্থ জীবন, ধৈর্য্য, ইবাদত ও সমাজসেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রহণ করলে এটি আমাদের জন্য আখেরাতেও কল্যাণ বয়ে আনবে। এই ঋতু আমাদের শরীর, মন ও আত্মার জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সোনালি সুযোগ।
লেখক, ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
এ জাতীয় আরো খবর..