×
  • প্রকাশিত : ২০২৫-১১-০৯
  • ১৩ বার পঠিত
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ :


স্বাস্থ্য কেবল রোগ না থাকার বিষয় নয়। এটি হলো মানুষের পূর্ণাঙ্গ সুস্থতা—শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে। সুসংগঠিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মানুষের জীবনমান উন্নত করে, মানসিক শান্তি বজায় রাখে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা আনে। সেই ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো চিকিৎসক। একজন দায়িত্বশীল ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক রোগীর জীবনকে সহজ ও সুস্থভাবে পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু যদি চিকিৎসক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন, তবে তা রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতি এবং সমাজে মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়।

বিশেষ করে ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের মধ্যে অপচিকিৎসা একটি গুরুতর সমস্যা। এটি রোগীর শারীরিক ক্ষতি করে, মানসিক শান্তি নষ্ট করে, অর্থনৈতিক বোঝা বাড়ায় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস করে। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের চাপ এবং বেসরকারি খাতের ব্যবসায়িক প্রবণতার কারণে অপচিকিৎসার প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।

ডিগ্রিধারী চিকিৎসক: কে তারা?

ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হলো সেই চিকিৎসক যারা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসাজ্ঞান অর্জন করে ডিগ্রি পেয়েছেন—যেমন MBBS, BDS, MD, MS বা সমমানের। তারা রোগ নির্ণয়, ঔষধ প্রয়োগ এবং চিকিৎসা পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত।

তাদের প্রশিক্ষণ সাধারণত তাত্ত্বিক শিক্ষা ও ক্লিনিকাল অনুশীলনের সমন্বয়ে হয়। তবে বাস্তব জীবনে রোগীর উপসর্গ এবং রোগ নির্ণয়ের জটিলতা বইয়ের শিক্ষার বাইরে চলে যায়। অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলে অপচিকিৎসার ঝুঁকি বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সাধারণ ফ্লু ও হেপাটাইটিসের মতো রোগ নির্ণয়ে সহজ বিভ্রান্তি গুরুতর চিকিৎসা ত্রুটির কারণ হতে পারে।

অপচিকিৎসা: সংজ্ঞা ও ধরন

অপচিকিৎসা হলো চিকিৎসা প্রদানের সময় কোনো ত্রুটি বা অবহেলা, যার ফলে রোগীর শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক ক্ষতি হয়। এর ধরনগুলো হলো:

১. ভুল রোগ নির্ণয়: যেমন, ইনফেকশনকে ক্যান্সার মনে করা বা সাধারণ অসুখকে হাইপারটেনশন ধরা।

২. অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার: রোগীর শারীরিক অবস্থা বা বিকল্প চিকিৎসা না ভেবে অপারেশন করা।

৩. ত্রুটিপূর্ণ ঔষধ প্রয়োগ: যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা হৃদরোগে ভুল ডোজ।

৪. চিকিৎসায় অবহেলা: অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অস্ত্রোপচার, পর্যবেক্ষণ না নেওয়া বা স্টেরিলাইজেশন নিয়ম না মানা।

৫. নৈতিক ও আর্থিক প্রলোভন: রোগীকে অতিরিক্ত পরীক্ষা বা চিকিৎসায় বাধ্য করা। অপচিকিৎসা সবসময় ইচ্ছাকৃত হয় না। অনেক সময় শিক্ষাগত অভাব, অভিজ্ঞতার ঘাটতি, ক্লিনিকাল ত্রুটি বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটে। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নৈতিক অবহেলা বা আর্থিক লোভ সরাসরি রোগীর ক্ষতির কারণ হয়।

অপচিকিৎসার প্রধান কারণ

ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের অপচিকিৎসার মূল কারণগুলো হলো:

১. শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা: বইয়ের জ্ঞান থাকলেও বাস্তব জীবন অনেক জটিল। অভিজ্ঞতার অভাব ভুল চিকিৎসার কারণ হতে পারে।

২. রোগীর চাপ ও সময়ের সীমাবদ্ধতা: সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগীর চাপ বেশি। দ্রুত রোগী দেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৩. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: নির্ভরযোগ্য যন্ত্রপাতি ও পরীক্ষার সুযোগ না থাকলে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া কঠিন।

৪. নৈতিক ও আর্থিক প্রলোভন: কিছু চিকিৎসক রোগীকে অতিরিক্ত পরীক্ষা বা চিকিৎসায় বাধ্য করে ব্যক্তিগত লাভের চেষ্টা করেন।

৫. রোগীর অমনোযোগ বা তথ্যের অভাব: রোগী চিকিৎসা প্রক্রিয়া ও বিকল্প সমাধান সম্পর্কে জানলে ত্রুটি কমতে পারে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই সব কারণ মিলিত হয়ে অপচিকিৎসার ঘটনা ঘটায়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, আর বেসরকারি খাতে কিছু চিকিৎসক রোগীর আস্থা ব্যবসায়িক সুবিধায় রূপান্তর করেন।

অপচিকিৎসার প্রভাব

* শারীরিক ক্ষতি: স্থায়ী অঙ্গহানি, সংক্রমণ, জটিলতা বা মৃত্যু। 
* মানসিক প্রভাব: ভয়, হতাশা, আস্থা ক্ষয় ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি।
* অর্থনৈতিক ক্ষতি: অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ঔষধ বা অস্ত্রোপচারে অতিরিক্ত খরচ।
* সামাজিক প্রভাব: স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমে যায়, চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক দুর্বল হয়।
* দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা: জটিলতা ও পুনরাবৃত্তি, যা জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি শিশু যদি ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা হয়, তার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ব্যাহত হতে পারে। পরিবারে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, অর্থনৈতিক বোঝা বেড়ে যায় এবং সমাজে অপচিকিৎসার খবর অন্যান্য রোগীর মধ্যে ভয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করে।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ

অপচিকিৎসা কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও চিকিৎসা ত্রুটির কারণে মৃত্যু বা স্থায়ী ক্ষতির ঘটনা ঘটে। তবে উন্নত দেশগুলিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ব্যবহার, রোগ নিরীক্ষণ ব্যবস্থা ও আইনগত ব্যবস্থা থাকায় এর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উন্নত দেশে চিকিৎসা ত্রুটি প্রায় ৫–১০% রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অনেক বেশি।

অপচিকিৎসা প্রতিরোধের উপায়

ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের অপচিকিৎসা কমাতে পদক্ষেপগুলো হলো:

১. নিয়মিত প্রশিক্ষণ: নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি, প্রযুক্তি ও মেডিকেল এথিক্স সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।

২. স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ ও অডিট: অভ্যন্তরীণ অডিট, রোগীর অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন ও চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা।

৩. রোগী ও পরিবারের সচেতনতা: চিকিৎসা প্রক্রিয়া, ঔষধ এবং বিকল্প সমাধান সম্পর্কে জানানো, যা ভুলের সম্ভাবনা কমায়।

৪. নৈতিক ও আইনগত ব্যবস্থা: কঠোর নীতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চিকিৎসকদের দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করে।

৫. প্রযুক্তি ব্যবহার: ডিজিটাল রেকর্ড, টেলিমেডিসিন, ইলেকট্রনিক রিসিপ্ট এবং উন্নত রোগ নির্ণয় যন্ত্র ব্যবহার অপচিকিৎসা কমাতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগীর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলের রোগীর চিকিৎসা মান নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে ডিগ্রিধারী চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও অপচিকিৎসার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় চিকিৎসক পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। বেসরকারি খাতে কিছু চিকিৎসক রোগীর আস্থা ব্যবসায়িক সুবিধায় রূপান্তর করেন। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক ও হাসপাতালের অভাব এবং রোগীর শিক্ষার অভাব ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। স্বাস্থ্য নীতি ও মেডিকেল কাউন্সিল থাকলেও জনসচেতনতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান উন্নয়ন না হলে অপচিকিৎসা কমানো সম্ভব নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের অপচিকিৎসা কেবল ব্যক্তিগত ভুল নয়; এটি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা, রোগীর জীবন ও সমাজের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। এর ফলে রোগীর শারীরিক ক্ষতি, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক বোঝা এবং সামাজিক প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয়।

মূল দায় সর্বদা চিকিৎসকের ওপর থাকলেও শিক্ষাগত সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞতার ঘাটতি, রোগীর চাপ, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং নৈতিক বা আর্থিক প্রলোভন অপচিকিৎসার মূল কারণ।

অপচিকিৎসা প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের অডিট, রোগী সচেতনতা, নৈতিক ও আইনগত ব্যবস্থা এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। দায়িত্বশীল চিকিৎসা চর্চা ও সচেতন রোগীর উপস্থিতি থাকলে অপচিকিৎসা প্রায়শই রোধ করা সম্ভব।

লেখক:
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
lube
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat